চিকিৎসা করাতে ‘মনোরোগী’ প্রতিবেশীকে বহরমপুরে নিয়ে এসেছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে সেই মনোরোগীর চ্যালার আঘাতে মৃত্যু হল মালদহের রতুয়া থানার খোলসানা পাড়ার বাসিন্দা গোষ্ঠবিহারী মণ্ডলের (৫৮)। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে বহরমপুর গোরাবাজার এলাকায় ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া কৃষ্ণনাথ কলেজের ‘মেইন হস্টেলে’। জলসম্পদ দফতরের কর্মী গোষ্ঠবিহারী মণ্ডলের মৃত্যুর খবর পেয়ে বুধবার সকালে বহরমপুরে এসে পৌঁছন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, “সত্যেন মণ্ডল নামে যাঁর চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন ওই ব্যক্তি, তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যে কাঠ দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, তা উদ্ধার হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গাড়ি ভাড়া করে মঙ্গলবার দুপুরে গোষ্ঠবিহারী মণ্ডল ও নিরঞ্জন ঘোষ নামে দুজন প্রতিবেশীকে সঙ্গী করে শক্তি মণ্ডল তাঁর দাদা সত্যেন মণ্ডলকে ডাক্তার দেখানোর জন্য মালদহের খোলসানা গ্রামের বাড়ি থেকে বহরমপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। রাতটুকু ‘মেFন হস্টেল’-এ কাটিয়ে বুধবার সকালে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু তার আগেই বিপত্তি ঘটে যায়। খবর পেয়ে ওই রাতেই বহরমপুর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। গোষ্ঠবিহারীবাবুকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত বলে জানান। ছেলে প্রণব মণ্ডল বলেন, “যার জন্য মালদহ থেকে এত দূর এল, তার হাতেই বেঘোরে প্রাণ হারাতে হল বাবাকে।”
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, মধ্য চল্লিশের সত্যেন মণ্ডলের মানসিক রোগের চিকিৎসা চলছে দীর্ঘ দিন। তিনি বহরমপুরের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আলি হাসানের চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দেড় বছর আগে ওই চিকিৎসকের অধীনে বহরমপুর চালতিয়া বিল লাগোয়া বেসরকারি একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন। ভাই শক্তিবাবু রানিতলা হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি জিয়াগঞ্জে বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। কিন্তু বিএড পড়ার জন্য তিনি এখন মালদহের বাড়িতেই রয়েছেন। তাঁর কথায়, “মানসিক রোগীকে সঙ্গে নিয়ে মালদহ থেকে বহরমপুর, এত দূরের পথ একা আসতে সাহস পাইনি। তাই প্রতিবেশী ওই দু’জনকে সঙ্গে আসার জন্য অনুরোধ করি। সেই মতো গাড়ির চালক-সহ ৫ জনে বহরমপুরে আসি।”
তাঁরা রাত ৯টা নাগাদ বহরমপুরে এসে পৌঁছন। কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শক্তিবাবু বলেন, “২০০৬ সালে আমি কলেজ থেকে পাশ করি। মেইন হস্টেলে থাকার জন্য সকলেই আমার পরিচিত। এছাড়াও আমাদের এলাকার চার জন ছাত্র এখন মেইন হস্টেলে থাকে। ওই চিকিৎসকের চেম্বারও হস্টেলের কাছেই। ফলে ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি গিয়ে চিকিৎসকের কাছে রোগীর নাম লেখানোর সুবিধার জন্য হস্টেলে ওই ছাত্রদের অতিথি হিসেবে এসে উঠি।” দোতলা হস্টেলের ৫ নম্বর ঘরে মালদহের সত্যব্রত মণ্ডল, গৌরাঙ্গ সরকার, মিঠুনচন্দ্র মণ্ডল ও সনাতন মণ্ডল এক সঙ্গে থাকেন। সত্যব্রতের কথায়, “ওই পরিবার পরিচিত হওয়ায় তাঁদের জন্য ঘর ছেড়ে দিয়ে আমরা চার জন অন্য ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।” ওই ৫ নম্বর ঘরে দুজন প্রতিবেশী এবং সত্যেন মণ্ডল ছিলেন। গাড়ির চালক ও শক্তি মণ্ডল ছিলেন হস্টেলের ১৪ নম্বর রুমে।
প্রতিবেশী নিরঞ্জন ঘোষ বলেন, “আমি একটা বিছানায় শুয়ে পড়ি। সত্যেন এবং গোষ্ঠবিহারীবাবু অন্য বিছানায় বসে গল্প করছিলেন। আচমকা সত্যেন দরজায় লাগানো কাঠের হুড়কো হাতে নিয়ে হস্টেলের দেওয়ালে রাখা ফটো ভাঙতে থাকে। জানালা ও টেবিলে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। বাধা দিতে গেলে গোষ্ঠবিহারীবাবুর মাথায় জোরে আঘাত করলে ঘরের মেঝেতে মুখ গুঁজে পড়ে যান তিনি। বেগতিক দেখে আমি কোনও ভাবে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে শক্তিকে ডাকতে থাকি। আমার চিৎকার শুনে তারাও সকলে নেমে আসে। তারা এসে দেখে ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।” পুলিশ এসে গোষ্ঠবিহারীবাবুকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। |