|
|
|
|
উরসে জমজমাট মেদিনীপুর বাজার |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
মাথায় লম্বা ব্যারেল এক হাতে ধরা। অন্য হাতে বগলদাবা করে ৭-৮টি মাদুর। আবার কেউ মাথায় চাপিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অ্যালুমিনিয়ামের খান চারেক হাঁড়ি। কাঁধে একাধিক ব্যাগ। সকলেরই গন্তব্য মেদিনীপুর স্টেশন।
স্টেশনেও পা ফেলার জায়গা নেই। চারদিকে লোক গিজগিজ করছে এমন নয়। প্ল্যাটফর্ম জুড়েই রয়েছে হাঁড়ি, কড়াই, মাদুর, কম্বল, বড় বড় ব্যারেল আর ব্যাগপত্র। তা আগলে রয়েছেন চার-পাঁচজন। যাঁরা সবাই বাংলাদেশ থেকে বিশেষ ট্রেনে মেদিনীপুরে এসেছিলেন সৈয়দ শাহ মুর্শিদ আলি আলকাদেরি আল বাগদাদির (মাওলাপাকের) ১১৩ তম তিরোধান দিবসে। এটাই উরস উৎসব। মেদিনীপুর শহরের জোড়া মসজিদে উরস পালিত হয় মহা সাড়ম্বরে। যে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে তো বটেই বাংলাদেশ থেকেও কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় জমান। সম্পন্ন ব্যক্তিরা বাস ভাড়া করে বা ব্যক্তিগত গাড়িতে আসেন। আর সাধারণ মানুষেরা আসেন ট্রেনে। সোমবার ছিল উরস। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছে শহরে। জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আসা বিশেষ ট্রেনটিতে এসেছেন প্রায় দু’হাজার মানুষ। মঙ্গলবার দেশে ফেরার পথেই তাঁদের অনেকে স্থানীয় বাজার থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছেন নানা ধরনের সামগ্রী।
বাংলাদেশের বাসিন্দাদের কাছে প্রিয় জিনিসের মধ্যে কী কী পড়ে? |
|
উৎসব শেষে ওপার বাংলায় বাড়ি ফেরা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ঘর গেরস্থালির প্রয়োজনীয় একাধিক জিনিসপত্র কেনেন বাংলাদেশীরা। তার মধ্যে সবার প্রথম রয়েছে, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি ও কড়াই। প্রতিটি পরিবার গড়ে ৩-৪ টি হাঁড়ি-কড়াই কেনেন। আর কেনেন মাদুর। প্লাস্টিক মাদুরের পাশাপাশি সবংয়ের মাদুরের চাহিদাও ভালো। এক একজন ৬-৭ মাদুর কিনেছেন। একাধিক কম্বলও কিনেছেন প্রায় সকলেই। মিষ্টির মধ্যে দু’ধরনের মিষ্টি খুবই প্রিয়। একটি ক্ষীরের গজা। আর অন্যটি হল মিহিদানা। সব মিলিয়ে দু’দিনের এই অনুষ্ঠানে মুসলিম সম্প্রদায়ের যেমন ধর্মীয় ভাবাবেগ রয়েছে ভীষণ রকম, তেমনি দু’দিন মেদিনীপুরের বাজারও জমে ওঠে উচ্চস্বরে। ব্যবসায়ীদের মতে, দু’দিনে বাংলাদেশীদের কেনাবেচার অঙ্কটাই কোটি ছাড়িয়ে যায়!
কিভাবে? মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী চিন্ময় দাসের কথায়, “আমি এ বছরই দু’দিনে ৯ কুইন্টাল ক্ষিরের গজা বিক্রি করেছি। যা সাধারণ ভাবে ৩-৪ মাসেও বিক্রি করা কঠিন।” ব্যবসায়ী পরিমল রায়ের কথায়, “আমার দোকান থেকে তো মাদুর, কম্বল কত যে বিক্রি হয়েছে বলার নয়।” এর বাইরে এই দু’দিনে হোটেল ব্যবসায়ীদেরও বাড়বাড়ন্ত। দু’দিনের জন্য কোনও নির্দিষ্ট ভাড়া নেই। ৮০০ টাকার ঘরও ১২০০-১৫০০ টাকায় নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে হোটেল ব্যবসায়ীদের আবার ঝক্কিও কম। সারাদিনে হয়তো দু’বার হোটেলের ঘরে ঢোকেন তাঁরা। বাকি সময়টা মসজিদেই কাটিয়ে দেন। হোটেল ব্যবসায়ী মানস দাসের কথায়, “এদের হোটেল ভাড়া দিয়ে কোনও ঝক্কি নেই। শুধু যাওয়ার সময় দু’একশ টাকা কমানোর জন্য চাপাচাপি করে। নাহলে সবই ভাল।” বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক মলয় রায়ের কথায়, “বাংলাদেশিরা দু’দিনেই মেদিনীপুর শহরের বাজার থেকে প্রায় কোটি টাকার বেশি জিনিস কেনেন।”
কিন্তু দেশেও তো এণমন জিনিস মেলে। তাহলে এখান থেকে এসব জিনিস কেনেন কেন?
বাংলাদেশ থেকে আগত তীর্থযাত্রী সাইদুল ইসলামের কথায়, “আত্মীয়, পড়শিরা এটা সেটা কিনে নিয়ে যেতে বলেন। এখানে দামও কিছুটা কম হয়। টেকসইও বেশি।” এখানে যে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি ২৪০ টাকায় কিনেছেন, সেটি বাংলাদেশের বাজারে ৩০০ টাকার কম নয়। আর মাদুর, কম্বলের ক্ষেত্রে আরও সস্তা। এখানে যে মাদুরের দাম সাড়ে ৪০০ টাকা, সেটি সেখানে ৭০০-৮০০ টাকার কম মেলে না। কম্বলেও ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দাম কম পড়ে। শুধু দাম কমটাই বড় কথা নয়। ইজ্জতেরও প্রশ্ন রয়েছে। ‘ইন্ডিয়ার’ হাঁড়িতে রান্না করছি, ইন্ডিয়ার শিলে বাটনা বাটছি, এতে আভিজাত্যও রয়েছে। অতিথিদের মাদুরে বসতে দিয়ে ভারতের মাদুরের গল্পও করা যায়। এটা তো কম বড় কথা নয়। বাড়িতে বিদেশি জিনিস থাকলে তার কদরই আলাদা। এ তো আর সকলের বাড়িতে থাকে না।
এই কারণে মেদিনীপুরের ব্যবসায়ীদেরও পোয়াবারো। বাঙালীর বড় উৎসব দুর্গাপুজোর বাজারের থেকে কোনও অংশে কম না। বাজার থাকে তুঙ্গে। তার জন্য আগে প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন ব্যবসায়ীরা। দিন রাত জেগে মিষ্টি তৈরি থেকে শুরু করে আগে থেকে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী জিনিসপত্র মজুত রাখা -সবই করেন আগে থেকেই। তারই সঙ্গে দামও কিছুটা বাড়িয়ে দেন বইকি। সেটা অবশ্য প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করতে রাজি নন। |
|
|
|
|
|