শৌচাগার বন্ধ, ট্রেন থেকে নেমে পা কাটা গেল বৃদ্ধের
ট্রেনের সব ক’টা কামরাতেই রয়েছে শৌচাগার। কিন্তু, ব্যবহার করার উপায় নেই। লোহা ঝালাই করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রত্যেকটির দরজা। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তাই দাঁড়িয়ে-থাকা ট্রেন থেকে নেমেছিলেন বছর বাষট্টির হাবুল গঙ্গোপাধ্যায়। তারই চরম মাসুল দিতে হল তাঁকে। এই প্রতিবেদকের চোখের সামন সেই ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
খড়্গপুর স্টেশনে ঢোকার খানিক আগে সিগন্যাল না পাওয়ায় দাঁড়ায় ট্রেন। হাবুলবাবু নেমে রেল লাইনের পাশের ফাঁকা জমিতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখেন, ট্রেন চলতে শুরু করে দিয়েছে। সামনেই খড়্গপুর স্টেশন। কামরায় বসে আছেন স্ত্রী বেলাদেবী। পড়িমড়ি করে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেন ওই বৃদ্ধ। দরজার রড ধরতে পারলেও পাদানিতে পা দেওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। ট্রেন ততক্ষণে গতি নিয়েছে। হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হাবুলবাবুকে। তাঁর দু’টো পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে রেললাইনের ধারের স্টোনচিপসে। দরজায় দাঁড়িয়ে সেই বীভৎস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন আমার মতো আরও অনেক যাত্রী। স্বামীর অবস্থা দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে চলেছেন বেলাদেবী।
খড়্গপুর স্টেশনে ঢোকার অনেকটা আগেই ডান পা হাঁটু থেকে ছিঁড়ে গেল। আর বাঁ পা কাটা গেল গোড়ালির কিছুটা উপর থেকে। রড থেকে হাত ছিটকে গেল তাঁর। শরীরটা ছিটকে পড়ল লাইনের ধারে। ট্রেন দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকল খড়্গপুরের দিকে। কেউ কেউ চেন টেনে দিলেন। পিছনে ফিরে দেখলাম ওই অবস্থাতেই কোনও রকমে বসে পড়েছেন বৃদ্ধ। ট্রেন থামতেই আমরা অনেকে ছুটে গেলাম তাঁর দিকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। ডান পায়ের হাঁটু থেকে ঝুলছে মাংসপিণ্ড। চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। হাবুলবাবু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে চলেছেন, “আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। একটা হাসপাতালে ভর্তি কর আমাকে।” ইতিমধ্যে চলে এসেছেন ট্রেনের চালক ও গার্ড। গার্ড চেঁচিয়ে বললেন, “একটা স্ট্রেচার চাই। না হলে ভদ্রলোককে তোলা যাবে না।” লোকাল ট্রেনে বাথরুমই নেই, তো স্ট্রেচার! আমরা কয়েক জন যাত্রী গোটা ট্রেন আঁতিপাতি খুঁজেও ওই জাতীয় কিছু পেলাম না।

ট্রেনের বন্ধ শৌচাগার।

আহত বৃদ্ধকে সাহায্য ট্রেনের গার্ডের।
দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
ও দিকে বৃদ্ধ ক্রমেই নিস্তেজ হচ্ছেন। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হাবুলবাবুকে পাঁজাকোলা করেই তোলা হল ওই ট্রেনে। খড়্গপুর স্টেশনে তাঁকে নামিয়ে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করাল রেলপুলিশ। আতঙ্কে হাবুলবাবুর স্ত্রী কথা হারিয়েছিলেন।
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, হাবুলবাবু ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলার বাসিন্দা। খড়্গপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে সস্ত্রীক আসছিলেন টাটানগর-খড়্গপুর লোকালে চেপে। বুধবার সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওই মেমু ট্রেনে চেপেছিলেন। কলকাতার অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় আমিও ঝাড়গ্রাম থেকে ওই ট্রেনেই উঠি। ছিলাম হাবুলবাবুর পরের কামরায়। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পর ট্রেনের অন্তত ছ’টি কামরায় গিয়ে শৌচাগার পরখ করে দেখি। প্রতিটিই ঝালাই করে বন্ধ।
ট্রেনের যাত্রীদের ক্ষোভ, শৌচাগার ব্যবহার করতে পারলে হাবুলবাবুকে তাঁর দু’টো পা এ ভাবে খোওয়াতে হত না। কেন এ ভাবে দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশো যাত্রীকে বিপন্ন হচ্ছে? এই ট্রেনটি (৬৮০১৬) টাটানগর থেকে সকাল ৪টে ৫০ মিনিটে ছেড়ে খড়্গপুর ঢোকে পৌনে ৭টা নাগাদ। রেলের এক কর্তা জানান, রাত ২টো ৪০ মিনিটে ট্রেনটি হাওড়া-আসানসোল (ভায়া খড়্গপুর-টাটানগর-আদ্রা-পুরুলিয়া) লোকাল হিসাবে চলে। টাটানগর থেকে খড়্গপুর যেতে ঘণ্টা আড়াই সময় লাগলেও হাওড়া থেকে আসানসোল অবধি যেতে এই লোকাল সময় নেয় প্রায় ১২ ঘণ্টা। অতটা সময় ধরে ট্রেনের শৌচাগার ব্যবহার করার উপায় নেই। সবচেয়ে সমস্যায় পড়েন মহিলা ও বয়স্করা। ডায়াবেটিসের রোগীদের অসুবিধা তো সাংঘাতিক।
ঘটনার কথা শুনেছেন দক্ষিণ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সৌমিত্র মজুমদার। তিনি বলেন, “আমি যতটুকু জেনেছি, তাতে ওই বৃদ্ধ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নামার চেষ্টা করেছিলেন।” তাঁকে বলা হয়, এটা ঠিক তথ্য নয়। গোটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমার মতো অনেকেই। তখন সৌমিত্রবাবু বলেন, “সেটাও হতে পারে। খোঁজ নিচ্ছি।” কিন্তু, ট্রেনে শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও কেন সেগুলির দরজা ঝালাই করে বন্ধ রাখা হয়েছে, সে প্রশ্নের জবাবে তাঁর বক্তব্য, “কোনও মেমু ট্রেনেই শৌচাগারের সুবিধা নেই। কিছু ট্রেনের কামরাগুলিতে শৌচাগার রাখা হলেও রেলবোর্ডের অনুমতি না পাওয়ায় সেগুলিকে বন্ধ রাখা হয়েছে।” রেলের এক কর্তার আরও যুক্তি, এই ধরনের মেমু ট্রেনগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুটে চলে। অথবা কয়েকটি কামরা কেটে নিয়ে অন্য রুটের ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। যেখানে যেখানে এই ধরনের মেমু যায়, সেখানে সব জায়গায় জলের সুবিধা নেই। ফলে, শৌচাগার পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না।
রেল সূত্রের খবর, খড়্গপুর থেকে হাবুলবাবুকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। বিকেলে সেখান থেকে তাঁকে কটকের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান আত্মীয়েরা। অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক।

(প্রতিবেদক আনন্দবাজার পত্রিকার চিত্র সাংবাদিক)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.