বর্জ্যের পর বর্জ্যের ঢল, দূষণের উপর দূষণ।
কলুষিত হতে হতে গঙ্গার জল এখন এমন অবস্থায় চলে এসেছে যে, তার মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন এক প্রজাতির জিন। যা কিনা বিভিন্ন জলজ ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্রে মিশে গিয়ে সেগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তুলছে বলে দাবি করলেন এক দল গবেষক। ব্রিটেনের নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লি আইআইটি-র বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান পত্রিকা ‘জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি’তে।
গবেষকদের দাবি: গঙ্গার উজানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জলের নমুনা সংগ্রহ করে তাঁরা জিনটি খুঁজে পেয়েছেন। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সব ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্রে সেটি প্রবেশ করে, অ্যান্টিবায়োটিক তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারে না। এখানেই শেষ নয়। অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়াগুলো এক বার মানুষের শরীরে ঢুকলে স্থায়ী ভাবে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে। অন্ত্রে বাসা বেঁধে বংশবিস্তার করে। এবং মলবাহিত হয়ে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে, সেখান থেকে আরও মানুষের দেহে। যে প্রক্রিয়া জারি থাকলে গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)- এর গবেষকদের অনেকে।
জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি’তে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক নিউ ক্যাসলের ডেভিড গ্রাহাম জানাচ্ছেন, গত বছর মে-জুনে তাঁরা হৃষিকেশ-হরিদ্বারে গঙ্গার জলের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। নমুনাগুলি পরীক্ষা করা হয় দিল্লি আইআইটি-র ল্যাবে। প্রতিটি নমুনাতেই হদিস মিলেছে বিশেষ জিনটির, গবেষকেরা যার নাম দিয়েছেন বিএলএএনডিএম-১। এর অস্তিত্ব প্রথম মালুম হয়েছিল ২০০৮-এ, দিল্লির যমুনাজলে। তার পরেই দিল্লি আইআইটি সবিস্তার গবেষণায় নামে। উদ্যোগের অংশীদার হয় নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়। |
ওদের যৌথ গবেষণার রিপোর্ট বলছে, মে-জুনে হৃষিকেশ-হরিদ্বারে পর্যটকের সংখ্যা বাড়লে গঙ্গার জলে বিএলএএনডিএম-১ জিনেরও পোয়াবারো হয়। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মে-জুনে তাদের সংখ্যা বাড়ে প্রায় ৬০ গুণ। বিজ্ঞানীদের অভিমত, জলে বর্জ্য মেশার ফলেই জিনটির জন্ম। কলিফর্ম-সহ গঙ্গার জলে বসবাসকারী যাবতীয় ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যেই তাঁরা এটির উপস্থিতি ধরতে পেরেছেন। যে কারণে গঙ্গাপাড়ের বাসিন্দাদের সতর্ক করেছেন।
গবেষকেরা জানান, কুম্ভ ইত্যাদি নানা তীর্থযাত্রাও গঙ্গার জলে বিএলএএনডিএম-১ জিনের পরিমাণ বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। “আমরা দেখেছি, বিভিন্ন তীর্থের সময়ে গঙ্গায় ওই জিনের উপস্থিতি অন্তত ২০ গুণ বাড়ে। তখন নদীর ধারে প্রাতঃকৃত্য যেমন বাড়ে, তেমন ফুল-বেলপাতার মতো বর্জ্য জলে মেশে। আমাদের অনুমান, এ হেন পরিস্থিতিতে জিনটির বংশবৃদ্ধি দ্রুত হয়।” লিখেছেন গ্রাহাম। নাইসেডের বিজ্ঞানী প্রভাসচন্দ্র সাধুখাঁর কথায়, “এটা এক ধরনের অভিযোজন। প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচার তাগিদে নতুন জিনের জন্ম।”
এবং হরিদ্বার বা হৃষিকেশের গঙ্গায় যখন এর সন্ধান মিলেছে, তখন কলকাতার গঙ্গাতেও তা পাওয়া যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয় বলে প্রভাসবাবুর আশঙ্কা। এই কথা মাথায় রেখে তাঁর সুপারিশ: গঙ্গার জলে বর্জ্য ফেলা অবিলম্বে বন্ধ করা জরুরি। নচেৎ জনস্বাস্থ্যে গুরুতর সঙ্কট দেখা দেবে। এ সম্পর্কে গঙ্গাপাড়ের অধিবাসীদের সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শও দেন তিনি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-বিজ্ঞানী শরদিন্দু চক্রবর্তীর আক্ষেপ, “গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে বর্জ্য ফেলা বন্ধের প্রস্তাব ছিল। তার পিছনে তিন দফায় বেশ কয়েকশো কোটি টাকা খরচও করেছে কেন্দ্র। তবু গঙ্গার জল দূষিত হচ্ছেই।”
মানুষকে সচেতন করা না-গেলে গঙ্গার দূষণ-সমস্যা যে মেটার নয়, গবেষণাপত্রটি তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বলে মনে করছেন ওই পরিবেশ-বিজ্ঞানী। |