এক্তিয়ার নিয়ে চাপানউতোর, আপত্তি রাহুলেরও
রাজীব গাঁধীর তিন হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড খারিজ করে গত কালই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায়ের ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই লোকসভা নির্বাচনের মুখে বড়সড় চমক দিলেন জয়ললিতা। আজ সকালে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, রাজীব হত্যায় দোষী সাত জনকেই মুক্তি দেবেন তিনি। এ জন্য কেন্দ্রের কাছে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। কেন্দ্র অনুমতি দেয় ভাল, না দিলে তিন দিনের মধ্যে রাজ্যই তাদের ছেড়ে দেবে।
জয়ার ঘোষণা পাতে পড়তেই শুরু হয়েছে চাপানউতোর। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য সরকার কি এ ভাবে মুক্তির সিদ্ধান্ত নিতে পারে? জয়ার বক্তব্য, ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪৩৫ ধারা অনুযায়ী অপরাধীদের মুক্তি দিতে কেন্দ্রের অনুমতি লাগবে। কিন্তু তিন দিনের মধ্যে কেন্দ্রের জবাব না এলে ওই কার্যবিধির ৪৩২ ধারায় রাজ্যই তাদের মুক্তি দিতে পারে। জয়ললিতার এই দাবি অবশ্য নস্যাৎ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তামিলনাড়ু সরকারের তরফে কোনও আর্জি আসেনি জানিয়ে মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “সিআরপিসি-র ৪৩৫ ধারায় স্পষ্টই বলা হয়েছে, কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা দ্বারা কোনও অপরাধের তদন্ত এবং কেন্দ্রীয় আইনে তার বিচার হলে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই দোষীদের শাস্তি কমাতে বা মুক্তি দিতে পারে।” রাজীব হত্যাকারীদের তদন্ত করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই। বিচারও হয়েছে কেন্দ্রীয় আইন টাডায়। ফলে অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার কোনও অধিকার রাজ্যের নেই, এমনটাই দাবি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গোটা বিষয়টি তারা পাঠিয়ে দিয়েছে আইন মন্ত্রকের কাছে।
কেন্দ্র-রাজ্য এই চাপানউতোরের বাইরে আরও একটা টানাপোড়েন থেকে যাচ্ছে জয়ার ঘোষণা ঘিরে। সেটা জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতির মধ্যে। দক্ষিণের দলগুলি জয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অংশে উৎসবও শুরু হয়ে গিয়েছে এ দিন। কিন্তু কংগ্রেস এর ঘোরতর বিরোধী। রাহুল গাঁধী নিজেই বলেছেন, “আমার বাবা শহিদ হয়েছিলেন। তবু ব্যক্তিগত ভাবে আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকারীদের যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তা হলে সাধারণ মানুষ কী বিচার প্রত্যাশা করবেন?”
প্রশ্ন হল, অতীতে রাজীব হত্যাকারীদের প্রতি মানবিক অবস্থান নেওয়া গাঁধী পরিবার এখন তাদের মুক্তির বিরোধিতা করছে কেন? খোদ সনিয়া গাঁধী অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, স্বামীর হত্যাকারীদের ক্ষমা করেছেন তিনি। বস্তুত, সনিয়ার হস্তক্ষেপেই ১৪ বছর আগে ফাঁসির দড়ি এড়িয়ে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন অন্যতম অভিযুক্ত মুরুগনের স্ত্রী নলিনী। কয়েক বছর আগে জেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন রাজীব-তনয়া প্রিয়ঙ্কা।
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন...
কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, ক্ষমার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এখনও চলছে গাঁধী পরিবার। তাই সুপ্রিম কোর্ট প্রথমে ফাঁসির সাজা দিলেও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারই তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। কিন্তু হত্যাকারীদের ফাঁসি মকুব এক জিনিস। আর তাদের যে ভাবে একেবারে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা বিপজ্জনক। একটি সর্বভারতীয় দলের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাতে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। সেই কারণেই গত কাল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ফাঁসি এড়ানো তিন আসামি শান্তন, পেরারিবালন ও মুরুগন এবং আগেই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নলিনী, রবার্ট পায়াস, জয়কুমার এবং রবিচন্দ্রনের মুক্তির বিরোধী তাঁরা।
কংগ্রেসের অবস্থান স্পষ্ট করে দলের সাধারণ সম্পাদক অজয় মাকেন প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘তামিলনাড়ু সরকারের সিদ্ধান্তের নিন্দা করছে কংগ্রেস। জয়ললিতার ঘোষণা অন্য মুখ্যমন্ত্রী এবং সাংবিধানিক পদাধিকারীদের সামনে এই ভুল নজির তৈরি করবে যে, আইনি সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। শান্তিকামী, আইনে আস্থা রয়েছে এমন মানুষের বিশ্বাসও জোর ধাক্কা খাবে।’
কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিও বলেন, “এক জন মুখ্যমন্ত্রী কি শুধুমাত্র পপুলিজমের জন্য সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তি দিতে পারে? কংগ্রেস এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করছে। আমাদের আশা, আদালত তামিলনাড়ু সরকারের এই সিদ্ধান্ত খারিজ করবে।”
কিন্তু জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতির সংঘাত স্পষ্ট হয়েছে তামিলনাড়ুর কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বলেছেন, “এই সিদ্ধান্তে আমি অখুশি নই। দোষীরা ইতিমধ্যেই অনেক সাজা পেয়েছে।” তাঁর এই মন্তব্য সম্পর্কে কংগ্রেসের সরকারি বক্তব্য, এটা চিদম্বরমের ব্যক্তিগত মত।
বিরোধীরা অবশ্য একে কংগ্রেসের দু’মুখো রাজনীতি বলেই সমালোচনায় মুখর। তাঁদের মতে, লোকসভা ভোটের মুখে তামিল আবেগের কথা ভেবে রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা জয়ললিতার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আবার সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্কে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সাংবিধানিক গরিমা ও নৈতিকতার কথা বলছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির এই ভারসাম্যের দায় রয়েছে বিজেপি-রও। তামিলনাড়ুতে বিজেপি-র তেমন জোর না থাকলেও লোকসভা ভোটের পরে জয়ার হাত ধরার আশা করে তারা। তাই আফজল গুরুর ফাঁসির দাবিতে বিজেপি যতটা সরব হয়েছিল, রাজীব হত্যাকারীদের ফাঁসি নিয়ে তারা ততটা আক্রমণাত্মক নয়। বরং সুকৌশলে বিষয়টির যাবতীয় দায় কংগ্রেসের উপরেই চাপাতে চায় তারা। বিজেপি নেতা মুখতার আব্বাস নকভি তাই বলেছেন, “কংগ্রেস এ ব্যাপারে বরাবরই নরম মনোভাব দেখিয়ে এসেছে। অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন মেনে নেওয়া হচ্ছে, কংগ্রেসই তার জবাব দিক।”
জয়ার সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে তামিলনাড়ুর প্রধান বিরোধী দল ডিএমকে-ও। স্থানীয় ভাবাবেগকে মর্যাদা দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানাতে হয়েছে তাদের।পাশাপাশি এ চেষ্টাও করতে হয়েছে, যাতে সবটুকু কৃতিত্ব এডিএমকে-র ভাগে না যায়। ডিএমকে প্রধান এম করুণানিধি বলেছেন, “এটা হঠাৎ করে নেওয়া কোনও সিদ্ধান্ত নয়। ২০১১-এ আমি এদের মুক্তির দাবি জানিয়েছিলাম। তখন উনি (জয়া) তাতে সায় দেননি। যা-ই হোক শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ওঁর প্রশংসা করছি।”
যদিও জয়ললিতার অভিযোগ, “করুণানিধি ক্ষমতায় থাকাকালীনই পেরারিবালন-সহ অন্য দুই আসামির ক্ষমাভিক্ষার আর্জি রাজ্যপালের কাছে খারিজ হয়েছিল। ২০০০ সালে তা খারিজ করেন রাষ্ট্রপতি। করুণানিধির সরকার যদি ক্ষমাভিক্ষার আর্জি শুনে রাজ্যপালের কাছে সুপারিশ করত বা মন্ত্রিসভায় কোনও সিদ্ধান্ত নিত, তা হলে এত দিন লাগতই না।”
সাত অপরাধীর পরিবার অবশ্য রাজনীতির অঙ্ক কষে নয়, নিকটজনের মুক্তির সম্ভাবনাতেই খুশি। পেরারিবালনের ৬৭ বছরের মা আরপুথাম্মাল বলেন, “গত কাল কিছুটা খুশি হয়েছিলাম। আজ আমি দারুণ খুশি। আম্মা (জয়ললিতা) অন্য মায়ের যন্ত্রণা বুঝতে পেরেছেন। আমার কষ্ট ওঁর জন্যই শেষ হবে।” জয়ললিতার সঙ্গে দেখা করে কৃতজ্ঞতাও জানাতে চান তিনি।
ভেলোরের সেন্ট্রাল জেলে বন্দি মুরুগন, শান্তন, পেরিরাবালন এবং নলিনীর কানেও পৌঁছেছে জয়ার ঘোষণার কথা। জেল কর্তৃপক্ষ জানান, ওদের আশা ছিল যে মুক্তি পাবে। সেই আশা উজ্জ্বল হওয়ায় খুশি ওরাও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.