‘এইচ্, নি, সান্, সি, গো, রুক, স্যাচ্...’
কিছু দিন ধরে মেয়েদের স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ সমস্বরে এমন অপরিচিত আওয়াজ কেউ কেউ হয়তো শুনেছেন। এমন কিছু শনতে পেলে নিশ্চিত হবেন, ওই স্কুলে তখন ‘কিউকুশিন’ শৈলীর ক্যারাটে প্রশিক্ষণ চলছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও সর্বশিক্ষা মিশনের অর্থ সাহায্যে ২০১৩ সালের প্রথম থেকে জেলার ৪০টি মেয়েদের স্কুলে ওই ক্যারাটে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজে বাড়তে থাকা নারী নির্যাতনের পরিস্থিতিতে মেয়েরা যেন নিজেরাই আত্মরক্ষা করতে পারে, সেটাই লক্ষ্য এই উদ্যোগের।
প্রতিটি স্কুলের পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৫০ জন করে মিলিয়ে মোট দু’ হাজার ছাত্রীকে আত্মরক্ষার এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যাকে ঘিরে এমন ভাবনা, টাকার অভাবে সেই প্রশিক্ষণ ছাত্রীরা আদৌ শেষ করতে পারবে কিনা, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রশাসন সূত্রে অন্তত তেমনটাই খবর। জানা গিয়েছে, টানা ২৪ মাসের প্রশিক্ষণ কালের মধ্যে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক মাস ছেদ পড়েছে। গত বছর মাত্র তিন মাস প্রশিক্ষণ হওয়ার পরে টাকার অভাবে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ক্যারাটে প্রশিক্ষণ। এর পর কোনও স্কুলে আক্টোবর থেকে কোনও স্কুলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফের ৪ মাসের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তারপর ফের অনিশ্চয়তা। প্রশিক্ষণের জন্য টাকা কী ভাবে বরাদ্দ হবে বা আদৌ হবে কি না, তার স্পষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না কেউ-ই। |
দুবরাজপুর সারদেশ্বরী বিদ্যামন্দির ফর গার্লস।—নিজস্ব চিত্র। |
কেন? জেলা প্রশাসন ও স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে সর্বশিক্ষা মিশনের ‘উদ্ভাবন খাতে’ থাকা টাকায় প্রথম শুরু হয় ক্যারাটে প্রশিক্ষণ। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) কৃষ্ণা মাড্ডি। আত্মরক্ষার পাশাপাশি স্কুলের মেয়েদের শরীর চর্চায় জোর দেওয়ার কথা মাথায় রেখে কৃষ্ণাদেবীই জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে জেলার প্রতিটি মেয়েদের স্কুল নিয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন। যে সব স্কুলে প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো নিজস্ব জায়গা রয়েছে এবং প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক এমন ৪০টি স্কুলকে বেছে নিয়ে শুরু হয় ক্যারাটে শিক্ষা। প্রতিটি স্কুলের ক্যারাটে প্রশিক্ষকের জন্য মাসে ৩ হাজার টাকা, প্রতি ছাত্রীর পোশাকের জন্য ৫০০ টাকা ও তাদের হাতে সামান্য কিছু টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তিন মাস চলার পরেই অর্থে টান পড়ে। রামপুরহাট ও নলহাটির মতো দু’একটি স্কুলের শিক্ষিকারা দু’এক মাস নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রশিক্ষকদের প্রাপ্য টাকা জোগাড় করতে পরলেও মে মাস থেকে নির্বাচিত ৪০টি স্কুলেই বন্ধ হয়ে যায় প্রশিক্ষণ। অনেক ভাবনাচিন্তার পরে দফতরের (জেলা সর্বশিক্ষা মিশন) প্রজেক্ট ম্যানেজম্যান্ট খাত থেকে বরাদ্দ হয় দ্বিতীয় দফার প্রশিক্ষেণের টাকা। কিন্তু সেটাও চার মাসের জন্য। চলতি ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হলে কী হবে, তা নিয়ে ফের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
গোটা জেলায় মেয়েদের ওই স্কুলগুলিতে ক্যারাটে শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন খয়রাশোলের কাঁকরতলার অলোক চট্টপাধ্যায়, রামপুরহাটের অভিজিৎ লেটরা। থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্টের অধিকারী ওই দুই প্রশিক্ষকই বলছেন, “প্রথমে কমলা তারপর নীল, হলুদ ও সবুজ বেল্ট অতিক্রম করে যতক্ষণ না এক জন ছাত্রী বাদামী বেল্ট পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করার মতো জায়গায় পৌঁছতে পারবে না। প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পরে এ ভাবে থমকে থমকে এগোলে মূল লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রক্রিয়াটাই ধাক্কা খাবে।” বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কিংবা প্রশিক্ষণে যোগ দেওয়া ছাত্রীরা সকলেই চাইছেন প্রশিক্ষণ যেন সম্পূর্ণ হয়। তা না হলে মূল উদ্দেশ্যটাই যে সফল হয় না।
ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এমন কিছু ছাত্রী যেমন, দুবরাজপুর সারদেশ্বরী বিদ্যামন্দির ফর গার্লসের সুলতানা খাতুন, মান্দিরা মাল, হেতমপুর রাজ উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের তিথি দাস, মল্লারপুর গার্লসের শ্রেয়শী দত্ত, রামপুরহাটের নারায়ণপুর মিশন গার্লসের সীমা দত্ত বা নলহাটি ফর গার্লস উচ্চবিদ্যালয়ের প্রমীলা হেমব্রমররা বলছে, “স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি এমন একটা বিষয় শেখার সুযোগ পাচ্ছি যা ভবিষ্যতে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। কেউ বলবে না যে মেয়ারা শারীরিক ভাবে দুর্বল। সেই সঙ্গে শরীরচর্চা করার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে বলে বেশ ভাল লাগছে। তবে একটাই চাওয়া প্রশিক্ষণ যেন নিয়মিত চলে।”
সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের প্রকল্প আধিকারিক অনিন্দ্য মণ্ডল। তিনি বলেন, “জেলার ৪০টি স্কুলে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দিতে গেলে বছরে ১৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। সর্বশিক্ষা মিশনের উদ্ভাবনী খাতে খুব বেশি টাকা ছিল না। তাই অর্থের অভাবে মাঝপথেই থমকে গিয়েছিল প্রশিক্ষণ। পরে প্রজেক্ট ম্যানেজম্যান্ট খাত থেকে বরাদ্দ হয়।” তাঁর দাবি, ওই খাত থেকে দফতরের কর্মীদর বেতন দিতে হয় বলে সেখান থেকে বারবার এ ভাবে টাকা খরচ করা সম্ভব হচ্ছে না। তা হলে এই জটের সমাধান কী করে হবে? অনিন্দ্যবাবু বলছেন, “প্রশিক্ষণরত সমস্ত ছাত্রীই যাতে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারে এবং সেই খাতে প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্ধ হয়, তার জন্য সর্বশিক্ষা মিশনের বার্ষিক বাজেটে ওই টাকা উল্লেখ করে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি রাজ্য যুব দফতরের যুগ্ম সচিবকেও সমস্যার কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় টাকার অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।” জেলা সর্বশিক্ষা মিশন দফতরের দাবি, এমন একটি জরুরী উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া আটকাতে তারা তৎপর হয়েছে। |