স্বাধীনতা ইস্তক এমন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দেখেনি ইউক্রেন। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। শ্রমিক সংগঠনের দফতর থেকে বিরোধীদের তাঁবু, টায়ার পুড়ছে নির্বিচারে। পেট্রোল বোমা, কাঁদানে গ্যাস, জল কামান বাকি নেই কিছুই। যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রস্থল ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারের চেহারার ফারাক নেই বললেই চলে।
গত তিন মাস ধরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের সাক্ষী কিয়েভের প্রাণকেন্দ্র এই ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ার। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা উপেক্ষা করে এখানেই তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন হাজার হাজার ইউক্রেনবাসী। গত ক’মাসে পুলিশের সঙ্গে একাধিক বার সংঘর্ষ হয়েছে তাঁদের। তবে গত কাল সন্ধে ছ’টার মধ্যে বিদ্রোহীদের ওই চত্বর ফাঁকা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় পুলিশি আক্রমণ। তাঁদের উপর পাল্টা চড়াও হন বিদ্রোহীরাও। দু’পক্ষের সংঘর্ষে কিয়েভে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জন পুলিশও আছেন। আহত কমপক্ষে ২৪১। সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন ইউক্রেন গঠন হয়েছে ২২ বছর আগে। এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আগে দেখেননি দেশবাসী। |
ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারে জ্বলছে বাড়ি। ছবি: এএফপি। |
গণ্ডগোলের সূত্রপাত ২০১৩ সালের নভেম্বরে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তি সই না করে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ। দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে প্রেসিডেন্ট আসলে তাঁদের ঠকাচ্ছেন, এই অভিযোগে উত্তাল হয়ে ওঠে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। ১৯৪৬ সালে শেভচেনকো বুলেভার্ডে বসেছিল লেনিনের এক বিশাল মূর্তি। নভেম্বর মাসেই জনরোষে বেদি থেকে উপড়ে পড়েন লেনিন। এ বছরের গোড়ার দিকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের উপর প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা জারি করলে, তখনও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি।
গত কাল রাত থেকে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় প্রতিবাদকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারের পূর্ব দিকের অংশ ফাঁকাও করে দিতে পেরেছে পুলিশ। তবে আক্রমণের মুখে পড়লেও তাঁরা যে পিছু হটতে রাজি নন, সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিরোধীরাও। ট্রেড ইউনিয়নের একটি অফিসের দখল নিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধরা। মঙ্গলবার রাতে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় পুলিশ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহী নেতারা যখন বক্তৃতা দিতেন, একটা বড় স্ক্রিনে তা দেখানো হতো। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তা-ও। চতুর্দিকে আগুনের বলয়ের মাঝে দাঁড়িয়েই মধ্য চল্লিশের এক ব্যক্তি জানালেন, “যত ক্ষণ না এই যুদ্ধে প্রতিবাদীদের জয় হচ্ছে, তত ক্ষণ কোথাও যাব না।” কাঁদানে গ্যাস, পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণ সত্ত্বেও বুধবার সকালে হাজার দশেক মানুষ ছিলেন ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আরও মানুষ যাতে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে না পারেন তাই কিয়েভে আসার রাস্তাঘাট আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বন্ধ সেখানকার পাতাল রেল চলাচলও। অন্য দু’টি শহরে প্রশাসনের সদর দফতর বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে বলে খবর পেয়েছে পুলিশ।
মঙ্গলবার রাতে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে এক প্রস্ত আলোচনায় বসেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। চরমপন্থীদের পাশ থেকে বিরোধীদের সরে দাঁড়ানোর আর্জিও জানান তিনি। সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি বিরোধী দলগুলো। উল্টে ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ার থেকে পুলিশ তুলে নেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।
ইউক্রেনের পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন পশ্চিমী দেশগুলি। অবস্থা সরেজমিনে দেখতে ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ডের বিদেশ মন্ত্রীরা আগামী কাল কিয়েভ যাচ্ছেন। এ দিকে, ইয়ানুকোভিচের সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ না হলে ইউক্রেনের উপর কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা ভাবছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ নিয়ে ব্রাসেলসে কাল একটি বৈঠকও ডাকা হয়েছে। রুশ বিদেশ মন্ত্রক সংঘর্ষের যাবতীয় দায় চাপিয়েছে বিদ্রোহীদের উপর। হিংসা ছেড়ে আলোচনায় বসার পরামর্শও দিয়েছে রাশিয়া। |