প্রবন্ধ ১...
কোথাকার জীবন যে কোথায় গড়ায়
বাসি হয়ে যাওয়া তর্ক: জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে, না কি চেতনার ছাপ জীবনধারাকে। দু’দিকেই যুক্তির পাহাড় জড়ো করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিতর্কের ক্ষেত্রেই যা অবধারিত, বিপরীত মতাবলম্বীরা নিজেদের বিশ্বাসে অটল থাকেন, যুক্তি ছাপিয়ে বিশ্বাস, বিশ্বাসকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যেই যুক্তির সমাবেশ, পক্ষ-প্রতিপক্ষ উভয়েই পরিতৃপ্ত চিত্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। হেঁয়ালি নিজের প্রকোষ্ঠে স্থিত থাকে।
মনে হয় প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছি; আশা করি একটু পরেই বোঝা যাবে, ঠিক তা নয়। আমরা বলি কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়। সেই ব্যাপার নিয়েই খানিকটা প্রগলভ হব। বাঙালি মধ্যবিত্ত অর্ধশতাব্দী ধরে যে মহিলাকে চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সম্ভাষণ করতে অভ্যস্ত, তিনি সম্প্রতি পরিণত বয়সে প্রয়াত হয়েছেন, সুচিত্রা সেন নামে তাঁকে সবাই গদগদ উচ্চারণে উল্লেখ করে এসেছেন। নেই-কাজ-তো-খই-ভাজ প্রবণতায় গবেষকরা অথচ আমাদের জ্ঞাত করবেন, সুচিত্রা সেনের অন্যতম অতীত পরিচয়, তিনি ঢাকা শহরের গেণ্ডারিয়া পাড়ার দুঁদে নাগরিক আদিনাথ সেনের নাতবউ। আরও একটু পিছিয়ে গেলে, পাবনা শহরের পুর বোর্ডের চাকুরে করুণাময় দাশগুপ্তের কন্যাদের এক জন। করুণাময়ের বিবিধ কর্তব্যের মধ্যে বসন্ত-প্রতিষেধক টিকে দেওয়া থেকে নর্দমা পরিদর্শন পর্যন্ত পড়ত। পাবনার মেয়েদের স্কুলে তাঁর তৃতীয়া কন্যা রমা, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত নামে পরিচিত ছিল। বাঙালি হিন্দু সংস্কার, সুন্দরী দুহিতার উপর যাতে কুদৃষ্টি না পড়ে, সে জন্য তাকে কুশ্রীতা দ্যোতক পোশাকি নামে আবৃত করা হত, রমা-কৃষ্ণা-সুচিত্রার এক-দু’জন স্কুলের সহপাঠিনী হয়তো এই কলকাতা শহরেই এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব।
এক উত্‌স থেকে। সুচিত্রা সেন (বাঁ দিকে) ও কনক মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু পুর বোর্ডের চাকুরিজীবী দাশগুপ্ত মহোদয় তো পাবনার আদি অধিবাসী নন, তাঁর জন্মসূত্রের অন্বেষণে আমাদের চলে যেতে হবে যশোরে। সেই জেলায় কালীগঙ্গা নদীর কূলে কালিয়া গ্রামে। কবে কোথা থেকে বৈদ্য সম্প্রদায়ের একটি অংশ কালিয়া গ্রামে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, কেউ জানেন না, তবে গোটা পূর্ববঙ্গ জুড়ে যে ক’টি বৈদ্য-প্রধান অঞ্চল, কালিয়া তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বিখ্যাততর, খুলনা জেলার সেনহাটির মতো। শস্যশ্যামল পরিবেশ, বছরভর গোলাভরা ধান, গৃহপালিত গবাদি জীব, বৈদ্যনন্দনরা চিকিত্‌সাবিদ্যার অনুষঙ্গে কেউ কেউ শাস্ত্রচর্চায়ও আগ্রহী ছিলেন। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে এগোতে জানতেন, সাহেবদের শাসন সুদৃঢ় হলে তাঁরা সংস্কৃতের পাশাপাশি অন্য অনেকের আগে ইংরেজি চর্চাও শুরু করলেন। এমনকী মেয়েদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁরা মস্ত পথপ্রদর্শক। কিন্তু প্রাচুর্য ও সাচ্ছল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত হারে সংখ্যা বৃদ্ধি হল। কালিয়া গ্রামে আর কুলোল না। কিছু কিছু জ্ঞাতি-বংশ সংলগ্ন গ্রামে বসবাস শুরু করলেন, যা যথানিয়মে ছোট কালিয়া নামে পরিচিত হল। ছোট কালিয়াও যখন উপচে পড়ল, তার অব্যবহিত পাশের গ্রাম বেন্দা বৈদ্য সম্প্রদায়ের নবতম উপনিবেশ। তিন গ্রাম জুড়ে জ্ঞাতিদের অবস্থান। কেউ কাছের জ্ঞাতি, কেউ আদৌ নিকট জ্ঞাতি নন, কিন্তু মামাতো, পিসতুতো, মাসতুতো নানা সম্পর্কের জটিলতা সত্ত্বেও পরস্পরকে আত্মজন বলে অভিহিত করতে তাঁদের আদৌ দ্বিধা বোধ নেই।
তবু সমস্যা। আত্মীয়-জ্ঞাতিবর্গের বিস্ফোরণের পরিণামে পরিবারের সম্পত্তি ভাগ হতে থাকল। প্রজাশোষণের মাত্রা বাড়িয়েও প্রতিটি পরিবারেরই আদায়-করা খাজনার পরিমাণ শীর্ণ থেকে শীর্ণতর। বাধ্য হয়ে অনেকেরই তাই কালিয়া-বেন্দার মোহিনী মায়াত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়া; কেউ কেউ জেলা শহরে বা অন্য জেলায়, কিংবা রাজধানী কলকাতায়। অনেকেই হয়তো ছিটকে বাংলার বাইরে। গত শতকের শুরুতে যে প্রবণতার শুরু, তা প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার পর চরমে পৌঁছল।
ঈষত্‌ বিস্ময় নিয়ে ফিরিস্তি শুনতে হয়। কালিয়া-বেন্দা থেকেই একদা, সম্ভবত উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে কিংবা তারও আগে উদয়শঙ্কর-রবিশঙ্করের পূর্বপুরুষ জীবিকার অনুসন্ধানে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ছাত্র, রাজকীয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অত্যুজ্জ্বল সদস্য, পরে কলকাতা হাইকোর্টের এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কুলদাচরণ দাশগুপ্ত, তাঁরও শেকড় কালিয়া-বেন্দায়। পোড়-খাওয়া কমিউনিস্ট নেতা রণেন সেন, দুর্ধর্ষ মহিলা সংগঠন নেত্রী কনক মুখোপাধ্যায়, তাঁদেরও জন্মকাহিনির সঙ্গে কালিয়া-বেন্দা সম্পৃক্ত। বিংশ শতাব্দীর তিরিশ-চল্লিশের দশকে বাংলা গানে যাঁর প্রতিভা নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যিনি কাজী নজরুলের অসংখ্য গানে সুর সংযোজন করেছেন এবং নজরুলগীতির ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখবার প্রয়াসে দশকের পর দশক ধরে নিমগ্ন থেকেছেন, সেই কমল দাশগুপ্তও কালিয়া-বেন্দার সন্তান। তালিকা আরও দীর্ঘ করা সম্ভব, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। সুচিত্রা সেনের পিতা একদা পাবনা শহরের স্যানিটারি ইনস্পেক্টর করুণাময় দাশগুপ্তেরও শিকড়ের টান একই। গত শতকের প্রথমার্ধে পাবনা শহরেই বাস করেছেন, হয়তো স্কুলে গিয়েছেন কিংবা পাবনা কিং এডওয়ার্ড কলেজে পাঠ নিয়েছেন, ওকালতি করেছেন, মহানায়িকার পিতার মতো সামান্য চাকরি করেছেন, অথবা শিক্ষকতা, বা স্রেফ জমিদারির টাকায় অট্টালিকা তুলে বিলাসি দিনযাপনে ব্যস্ত থেকেছেন, অথচ পরে নানা বিচিত্র জীবনজিজ্ঞাসায় তাড়িত হয়ে এই উদার পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছেন, তাঁদের সংখ্যা তো নিরূপণ করা সহজ নয়। উন্মেষ কাহিনি যা-ই হোক, তাঁদের জীবনধারা পরস্পরের থেকে দূরে, বহু দূরে, বহুতর দূরে সরে গিয়েছে। মাত্র কয়েক জন বিখ্যাত ব্যক্তির উল্লেখ করব, যাঁরা কোনও না কোনও সময় পাবনা শহরের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন, তার পর তাঁদের জীবনধারা বিভিন্ন প্রবাহে বয়ে গিয়েছে: সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী, ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-র প্রতিষ্ঠাতা শচীন চৌধুরী, তাঁর অনুজ ‘মুম্বই ফিল্ম টকিজ’ খ্যাত হিতেন চৌধুরী, তাঁদের সর্বকনিষ্ঠ অনুজ ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরী, গণিতজ্ঞ রাজনীতিবিদ একদা জনসঙ্ঘের সভাপতি দেবপ্রসাদ ঘোষ, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রকাশক আতোয়ার রহমান, কবি-সঙ্গীতজ্ঞ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, প্রাজ্ঞ দার্শনিক হিসেবে খ্যাত শিবনারায়ণ রায়, কবি মণীন্দ্র রায় এবং অবশ্যই বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা স্বয়ং।
ঢাকা শহর কিংবা সেই শহরের গেণ্ডারিয়া পাড়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন যুক্তিযুক্ত হবে না, কারণ আদিনাথ সেনের নাতবউয়ের সঙ্গে ওই ভূখণ্ডের সংযোগ নিছক বিবাহসূত্রে, কখনও যাননি, থাকেননি, ব্যক্তি চেতনায় তার পরিভাস আদৌ সম্ভব নয়। তবে যে তর্কের উল্লেখ দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরতে হয়। সুচিত্রা সেন-কনক মুখোপাধ্যায় উভয়ের চেতনার সঙ্গেই জড়িয়ে কালিয়া-বেন্দা। কিন্তু জীবনধারায় যোজন-যোজন তফাত। যেমন তফাত কমল দাশগুপ্তের জীবনধারার সঙ্গে কুলদাচরণ দাশগুপ্তের। চেতনা স্থবির, স্থাণু হয়ে কোথায় কোন সঙ্গোপনে তলিয়ে থাকে, জীবন নিজেকে তৈরি করে নেয়, হয়তো অহরহ নতুন করে তৈরি করে; কারও-কারও জীবনধারা ঋজু সরলরেখায় এগোয়, অন্য কারও-কারও মাঝে-মধ্যে এ-দিক-ও-দিক হতে চায়। সেই এ-দিক-ও-দিক হওয়াটাই জীবনধারায় দাঁড়িয়ে যায়। এবং জীবনযাপনের বিভঙ্গই মানসিকতা তৈরি করে। পছন্দ-অপছন্দ, বাছ-বিচার, রুচি-অরুচি, চিন্তার প্রবাহ সমস্ত কিছুই জীবনযাপনের প্রকৃতি দিয়ে প্রভাবিত হয়, অর্থাত্‌ জীবনধারাই চেতনাকে গড়ে।
তবে তর্কের তো শেষ নেই, যুক্তির জবাবে প্রতিযুক্তিও তো দাঁড় করানো হয় বহু ক্ষেত্রে। আমি শুধু সুচিত্রা সেন-কনক মুখোপাধ্যায়দের দৃষ্টান্ত থেকে একটি সিদ্ধান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। কেউ তার প্রতিযুক্তি শানাবেন কি না, জানি না।
অন্য একটি প্রসঙ্গ নিয়েও নাড়াচাড়া করতে যদিও আমি আমোদ পাই। জীবনধারা কার কোন দিকে গড়াবে, তা-ও কিন্তু সব ক্ষেত্রে গোড়া থেকে হিসেব কষে বলে দেওয়া মুশকিল। হঠাত্‌ হঠাত্‌ জীবনধারার উপর আকস্মিকতার ছায়া পড়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়েছি বসিরহাটে এক বন্ধুর সঙ্গে একবেলা গ্যাঁজাব, এ রকম পরিকল্পনা নিয়ে। এসপ্ল্যানেডে যথাযথ বাস খুঁজছি, অন্য এক বন্ধু পাকড়াও করল, রাত কাটালাম ডায়মন্ডহারবারে। ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে জাপানি আক্রমণে বিধ্বস্ত চিন দেশের দুর্গতদের চিকিত্‌সা-পরিচর্যার জন্য যে ভারতীয় চিকিত্‌সক দলের নাম প্রথম ঘোষিত হয়েছিল, তাতে রণেন সেন অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি মার্কামারা বিপ্লবী, বিদেশি প্রভুরা তাঁকে পাসপোর্ট দেবেন না, তাই তিনি সুহৃদ তরুণ চিকিত্‌সক বিজয়কুমার বসুর নাম নিজের বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করলেন। বিজয় বসুর অন্তত জীবনের মোড় ঘুরে গেল। তিনি বেশ কয়েক বছর বাদে দেশে ফিরলেন আকুপাংচার চিকিত্‌সাশাস্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, আমাদের দেশে সেই চিকিত্‌সা পদ্ধতির পত্তন ঘটল। কী থেকে যে কী হয়, অনেক সময়েই আগে থেকে বলা মুশকিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.