নয় বত্সরের বয়কটের পাট চুকাইয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদী বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করিয়াছে। ২০০৫ সাল হইতে মোদীর সংস্রব পরিহারে বিশ্বাসী ছিল মার্কিন দেশ, তাঁহার ‘মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ’-এর অভিযোগে। তাঁহাকে ভিসা দানে অসম্মতি জানানো হইয়াছে একাধিক বার। ‘ভিসা’র প্রশ্নটি এখনও বিশ বাঁও জলে, তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলের সাম্প্রতিক গাঁধীনগর সফর বড় রকমের কূটনৈতিক পথ পরিবর্তনের দ্যোতক। জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নাই, নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে মোদীর শক্তিমত্তাও প্রত্যহ বাড়িতেছে, এমতাবস্থায় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক-বিমার হিসাব করিতে আমেরিকা ভুল করে নাই। ভারত তাহার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাহার প্রধানমন্ত্রী পদে বসিবার সম্ভাবনা আছে, এমন এক জন রাজনীতিকের প্রতি ‘আদর্শবাদিতা’র কারণে মুখ ফিরাইয়া থাকা আমেরিকার পক্ষে কঠিন। সময় থাকিতেই পশ্চাদপসরণ করিয়া নিজের বাস্তববাদী কূটনীতির পরিচয় দিল ওয়াশিংটন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলিতে যতই একটি একশৈলিক অস্তিত্ব কল্পনা করা হউক না কেন, প্রকৃতপক্ষে ওয়াশিংটনে বহু স্বার্থগোষ্ঠী, বহু মতগোষ্ঠীর সমাগম ও সংঘাত। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক যাহা সিদ্ধান্ত করে, অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কিন্তু তাহা সমর্থন করে না। বিশেষ লবির চাপে কোনও পদক্ষেপ লইতে হইলেও অন্যান্য লবি তাহার বিপক্ষে লাগাতার লড়িতে থাকে। বিভিন্ন মার্কিন ব্যবসায়িক স্বার্থগোষ্ঠী গত কয়েক বত্সর যাবত্ বিশেষ চাপ দিতেছে মোদী-‘বয়কট’ প্রত্যাহারের জন্য। এই চাপ-রাজনীতির পিছনে গুজরাতের নজরকাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের আকর্ষণ ছাড়াও আরও কতকগুলি কারণ ছিল। প্রথমত, যে মুখ্যমন্ত্রী গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তিন-তিন বার জয়যুক্ত হইয়া এক দশকাধিক সময় নিজ রাজ্যের দায়িত্ব সামলাইয়াছেন, কোন যুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই জনপ্রতিনিধিকে বয়কট করিতে পারে? দ্বিতীয়ত, ভারতের বিচারব্যবস্থা মোদীকে দাঙ্গার দায় হইতে মুক্ত ঘোষণা করিয়াছে। তৃতীয়ত, মনে করিবার বিলক্ষণ হেতু আছে, সার্বভৌম রাষ্ট্রের এক মুখ্যমন্ত্রী বিষয়ে এই অবস্থান আমেরিকা বজায় রাখিতে পারিয়াছে ইউ পি এ সরকারের পরোক্ষ প্রণোদনার কারণেই। যে আমেরিকা অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দোহাই দিয়া বহু গুরুতর সংকট হইতে মুখ ফিরাইয়া থাকে, তাহার পক্ষে কার্যত ভারতের আন্তর্দলীয় রাজনীতির শরিক হইয়া এই মোদী-বিরোধিতা স্বভাবতই দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলিয়াছে।
দ্বিচারিতা ইউ পি এ-র তরফেও স্পষ্ট। মোদী রাজনৈতিক ‘শত্রু’ বলিয়া কোনও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার তাহার নিকট স্বাগত, আর দেবযানী খোবরাগাড়ের ক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার হইল সার্বভৌম দেশের অসম্মান: এই জ্বলন্ত দ্বিচারিতা সরকারের মহিমা বৃদ্ধি করে নাই। এমনকী এই বারেই ন্যান্সি পাওয়েলের সফর লইয়া বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের প্রকাশ্য মন্তব্যটিই বুঝাইয়া দিল যে, কংগ্রেস ইহাকে কেবল মার্কিন অভ্যন্তরীণ নীতি হিসাবে না দেখিয়া নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হিসাবে ব্যবহার করিতে চায়। অথচ এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে সঙ্গত ছিল নীরবতা বজায় রাখা, কেননা মার্কিন অবস্থানের পরিবর্তনশীলতার বিষয়ে দিল্লির কোনও দায় বা দায়িত্ব থাকিবার কথা নয়। মার্কিন মিত্রতার হস্তের সহিত কংগ্রেসের সংকীর্ণ রাজনীতির আরও একটি প্রমাণ: মাঝখান হইতে নরেন্দ্র মোদীর ভাগ্যে জুটিয়া গেল দুইটি জয়টিকা। তাঁহার সতীর্থরা ন্যান্সি পাওয়েলের সাক্ষাত্কারকে মোদীর বিজয় হিসাবে বিজ্ঞাপিত করিতে ব্যস্ত। বিজ্ঞাপন সচরাচর সত্য অপেক্ষা অনেক দূর আগাইয়া যায়, তাহাই বিজ্ঞাপনের ধর্ম। কিন্তু মোদীর আত্মপ্রচারের বাড়তি সুযোগ করিয়া দিয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব অষ্টোত্তর শত ভ্রান্তির তালিকায় আরও একটি যোগ করিয়াছেন। অবশ্য তালিকাটি তো অনন্তসন্ধানী। |