মহাভারত থেকে গুন্ডে।
আরও এক বার ডাবিং বিতর্ক তাড়া করছে টালিগঞ্জকে।
বাংলায় ডাব করা টেলি-ধারাবাহিক দেখানোর বিরুদ্ধে এর আগেও প্রতিবাদ হয়েছে। প্রথম যখন হলিউডি ছবি হিন্দিতে ডাব করে দেখানো শুরু হয়, বিতর্ক বেধেছিল তখনও। এ বারের বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে
যশরাজ ফিল্মস-এর গুন্ডে। কলকাতায় শু্যটিং হওয়া এই ছবিটি এ রাজ্যে হিন্দির পাশাপাশি একটি বাংলায় ডাব করা সংস্করণেও মুক্তি পেয়েছে।
বাংলা ছবির বাজার এতে সংকুচিত হবে বলে অভিযোগ করে তাই সরব হয়েছে টলিউড।
সোমবার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত মোহতা, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, রজতাভ দত্ত, অরিন্দম শীলরা রীতিমতো বৈঠক করে সিনেমা হল এবং টিভি চ্যানেলে ডাব করা ছবি/ধারাবাহিক দেখানো বন্ধ করার আর্জি জানিয়েছেন। ‘গুন্ডে’কে কেন্দ্র করে আলোচনা শুরু হলেও বাংলায় ডাব করা ‘মহাভারত’ মায় তামিল-তেলুগু হিট ছবি দেখানোর বিরুদ্ধেও ডাক দেওয়া হয়েছে। |
এই আর্জি শুনে কী বলছেন প্রদশর্ক-পরিবেশক-চ্যানেল কর্ণধাররা?
পূর্ব ভারতে ‘গুন্ডে’র পরিবেশক প্রীতম জালান। তিনি বলছেন, “আমাকে কোনও চিঠি দেওয়া হয়নি। আমরা ক্লিয়ারেন্স নিয়েই ছবি রিলিজ করেছি। কেউ বাধা দেয়নি। ডাবিং বন্ধ করতে হলে তেমন আইন করা হোক, তখন মেনে নেব।”
জি বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় কার্যনিবাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট সুজয় কুট্টি বলছেন, “এখনও সিদ্ধান্তে আসিনি। ৮-১০ বছরের পুরনো তামিল/তেলুগু ছবিই বাংলায় ডাব করে আমরা দেখাই। নতুন কোনও ছবির অফিশিয়াল রিমেক ঘোষণা হলে কিন্তু তার বাংলা ডাব করা ভার্সন আমরা আর দেখাই না।” স্টার জলসা বা সোনি আট-এর কর্ণধারদের সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।
অতঃ কিম? প্রযোজক হিমাংশু ধানুকা বলছেন, “১৫ দিন পরেও যদি কোনও সুরাহা না হয়, তা হলে সব প্রযোজক এবং কলাকুশলী মিলে চ্যানেল হেডকে অনুরোধ করব, যাতে তাঁরা এ বিষয় নিয়ে ভাবেন।” প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতাও একমত। বলছেন, “১৫ দিনের মধ্যে যদি চ্যানেলের তরফ থেকে কিছু না শুনতে পাই, তা হলে আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করব।”
আর সিনেমা হল-এ কী হবে? গত সপ্তাহে শিখা মল্লিক ঠিক করেছিলেন, শেওড়াফুলিতে তাঁদের ‘সুষমা’ সিনেমা হল-এ বাংলা ‘গুন্ডে’ চালাবেন। ডাবিংয়ের বিরুদ্ধে ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীরা সরব হয়েছেন, শুনেছেন। এখন বলছেন, “আমরা ছোট প্রদর্শক। এখন অফ সিজন। বাংলা ‘গুন্ডে’ মোটামুটি ব্যবসা করছে। ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীরা নিজেদের দিক থেকে ঠিক। কিন্তু ডাব্ড ছবি না চালিয়ে তো আমরা হল বন্ধ রাখতে পারি না!” বুকার রণজয় মজুমদার বাংলা ‘গুন্ডে’র বুকিং করেননি। “বুকার হিসেবে আমি ডাব্ড ছবি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী। কিন্তু প্রযোজক আর টেকনিশিয়ানদের অনুরোধে ‘গুন্ডে’র বুকিং করতে পারিনি। এর পরে এমন কাজ এলে ভেবে দেখব। কারণ এগ্জিবিটরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ডাব্ড ছবি চালালেও আমাদের লাভ,” বলছেন রণজয়।
প্রীতম মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৫ বছর আগে দক্ষিণ ভারতে এই রকম সমস্যা হয়েছিল। হল-এ দর্শক যেত না। তখন সব ভাষায় ছবি ডাব করে রিলিজ করা শুরু হল। যশরাজ সম্প্রতি ‘ধুম ২’ ও ‘ধুম ৩’ তামিল আর তেলুগুতে ডাব করে চালিয়েছে। ‘ক্রিশ’ এবং হলিউড ছবিও ডাব হয়েছে। প্রীতমের বক্তব্য, “এ সবে তামিল/তেলুগু ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি হয়নি। যদি ক্ষতি হত, তা হলে তো আইন করেই ডাবিং বন্ধ করা হত।” বাংলা ‘গুন্ডে’ ৪২টা হল-এ মুক্তি পেয়েছে। অসমে চারটেয়। জামশেদপুরে একটায়। “দ্বিতীয় সপ্তাহে আরও বেশি হল-এ বাংলা ‘গুন্ডে’ চলবে,” বলছেন প্রীতম।
এই দাবির সবটা মানছেন না শ্রীকান্ত। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “অনেক মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। হাবড়ার ‘রূপকথা’তে ‘বাঙালি বাবু দেশি মেম’ চলছে। এ দিকে খবরে বলা হয়েছে যে, ওখানে নাকি বাংলা ‘গুন্ডে’ ভাল ব্যবসা করছে। আসলে খুব কম জায়গাতেই ছবিটা চলছে।”
শিখা দেবী যেমন ছোট প্রদর্শকদের স্বার্থের কথা বলছেন, ছোট প্রযোজকদের হয়ে কথা বলছেন মিলন ভৌমিক। বাংলা ফিল্ম প্রোডিউসর অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাসোসিয়েশন-এর এই আহ্বায়ক বলছেন, “এক শ্রেণির মুনাফালোভী প্রযোজক আছেন যারা চোরদের বলছেন চুরি করো, আর পুলিশকে বলছেন চোর ধরো। এই ডামাডোলে ছোট প্রযোজক মারা যাচ্ছে।”
সাবধানী কলাকুশলীরাও। ৪০০ ছবিতে ডাবিং করেছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়। তবু তিনি বলছেন যে, বাংলায় ডাব করা কিছু দেখানো উচিত নয়। “কোনও বলিউড স্টার বাংলায় কাজ করলে তাঁর গলা ডাব করি। সেটা ছবিকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু পুরো একটা ছবিকে যদি ডাব করা হয়, তা হলে বাংলার শিল্পীদের কী হবে?”
পরিচালক শেখর দাস ছিলেন না সোমবারের বৈঠকে। তিনিও বলছেন, “ডাবিং না হওয়াই ভাল। মেনস্ট্রিম ছবির মার্কেট কমে গেলে আমাদের মতো প্যারালাল ছবির মার্কেটেও প্রভাব পড়বে। বাংলায় মাত্র ৩০০টা হল। ডাব্ড সিনেমা যদি হল খেয়ে নেয়, তা হলে আমাদের প্যারালাল ছবি চলবে কী করে?”
তবে তিনি এটাও বলছেন যে, অন্য ছবি বাংলায় ডাব করা না হলে কিন্তু বাংলা ছবিও অন্য ভাষায় ডাব করা বন্ধ হয়ে যাবে। “সুভাষ ঘাই ‘নৌকাডুবি’ হিন্দিতে ডাব করে চালিয়েছিলেন। আমরা ডাবিংয়ের বিরুদ্ধে সরব হলে তেমন আর হবে না। তবে আগে তো নিজেদের বাঁচাব। তার পর বাইরে গিয়ে ডাব করে নিজেদের ছবি চালানোর কথা ভাবব!” শেখর জানাচ্ছেন। |