প্রবন্ধ ২...
একটি বাজেট বক্তৃতা, যা আমরা শুনব না
বাজেট বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। বিশেষ করে নানা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এখন শ্রোতারা কোনও কিছু একটানা কুড়ি মিনিটের বেশি শুনতে পারেন না, ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। জনপ্রতিনিধিরা হয়তো আর একটু বেশি ধৈর্যশীল। ধরে নেওয়া যাক, তাঁদের মনোযোগের দৌড় ত্রিশ মিনিট। তাই আধ ঘণ্টার বেশি ভাষণ না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে পরিবেশেরও উপকার।
এক গভীর সংকটের ছায়ায় এই বাজেট তৈরি করতে হয়েছে। আয়বৃদ্ধির হার খুব কমে গেছে, বাজার দর দ্রুত বেড়ে চলেছে, সরকারি আয়ব্যয়ে ঘাটতি বেলাগাম। আগের সরকার ২০১৩-১৪’য় আয়বৃদ্ধির যে হিসেব কষেছিলেন, প্রকৃত বৃদ্ধির হার তার চেয়েও কম, ৪.৯ শতাংশের বেশি নয়। ২০১৪-১৫’র প্রথম ত্রৈমাসিকের আগাম হিসেব দেখাবে, এই তিন মাসে (এপ্রিল থেকে জুন) ৫ শতাংশ ছাড়াবে না। পাশাপাশি, মূল্যস্ফীতির হার কিন্তু নামেনি, সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৮.৫ শতাংশ।
সত্যি কথা বলতে কী, দায়িত্ব নেওয়ার আগে পর্যন্ত আমরাও বুঝতে পারিনি, কোষাগারের অবস্থা কতটা খারাপ। রাজকোষ ঘাটতিকে জিডিপি’র ৪.৬ শতাংশে বেঁধে রাখতে পেরেছেন বলে ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী খুবই আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই হিসেবে জমা এবং খরচ দু’দিকেই নানা ধরনের কৌশল ছিল। সে সব সরিয়ে রেখে বাস্তবসম্মত হিসেব কষে আমরা দেখেছি, ২০১৩-১৪ সালে রাজকোষ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫.৪ শতাংশ। আর একটা কথা। বাজেটের হিসেবের বাইরেও সরকার নানা রকম প্রচ্ছন্ন ভর্তুকি দেয়। সেগুলিকেও আসলে রাজকোষ ঘাটতির অংশ হিসেবেই বিচার করা উচিত। সে সব ধরলে রাজকোষ ঘাটতির অনুপাত দাঁড়ায় ৮.৫ শতাংশ। আমাদের এই ঘাটতির উত্তরাধিকার নিয়েই শুরু করতে হচ্ছে।
বাস্তব যে রকম। পি চিদম্বরম। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪। ছবি: রয়টার্স।
জমা-খরচের মূল হিসেবে আসার আগে দু’একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানাতে চাই। কিছু নীতি ইতিমধ্যেই ঘোষিত এবং বলবৎ হয়েছে। এগুলি মূল বাজেটের অঙ্গ নয়, কিন্তু সরকারি আয়ব্যয়ের ওপরে এই সব নীতির প্রভাব বিপুল, তা ছাড়া প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও এগুলি বিশেষ সহায়ক হবে। প্রথমেই বলি, আমরা মন্ত্রিসভার আয়তন অনেক ছোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এক এক জন মন্ত্রী এবং তাঁর দফতরের জন্য সরকারের কত খরচ হয়, তার ঠিক হিসেব কষা খুব কঠিন। কিন্তু খরচটা যে অনেক, সে বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। আমরা দুটি পরিবর্তন ঘটিয়েছি। এক, সমস্ত প্রতিমন্ত্রীর পদ লোপ করা হয়েছে, স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীও আর রাখা হয়নি। দুই, মন্ত্রী এবং মন্ত্রকের মোট সংখ্যা পঁচিশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সে জন্য অনেক মন্ত্রক তুলে দেওয়া হয়েছে, অনেকগুলিকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, কৃষি এবং গ্রাম উন্নয়ন, দুটি মন্ত্রক এখন মিশে গেছে। পরিকাঠামো, জ্বালানি, শিল্প, সামাজিক ক্ষেত্র ইত্যাদির প্রত্যেকটির জন্য একটি মন্ত্রক তৈরি হয়েছে, প্রত্যেকটির মধ্যেই আগের একাধিক মন্ত্রক লীন হয়ে গিয়েছে। সংস্কৃতি এবং তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক তুলে দেওয়া হয়েছে। নানা ধরনের ‘মন্ত্রী-গোষ্ঠী’ও আর নেই, মন্ত্রিসভাই সমস্ত সিদ্ধান্তের জন্য সমষ্টিগত ভাবে দায়বদ্ধ থাকবে, যেমনটি সংবিধানে চাওয়া হয়েছে।
কেন্দ্র এবং রাজ্যের সম্পর্ক কী ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ অনুসারে চালনা করা যায়, আমরা সে বিষয়ে মনোযোগী। আমরা ইতিমধ্যেই যোজনা ব্যয় এবং যোজনাবহির্ভূত ব্যয়ের কৃত্রিম ও অর্থহীন বিভাজন বাতিল করেছি। একই সঙ্গে, কোনও নির্ধারিত সূত্র ছাড়াই যোজনা কমিশন মারফত বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে নানা ধরনের বরাদ্দ বণ্টনের যে অযৌক্তিক প্রথা চালু আছে, সেটিও রদ করা হয়েছে। এই সব বরাদ্দ এখন থেকে অর্থ কমিশন মারফত বণ্টন করা হবে। যোজনা কমিশনের ইচ্ছাধীন (ডিসক্রেশনারি) অর্থ বণ্টনের ব্যবস্থাটি কাজ করে কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রের প্রকল্প (সেন্ট্রাল সেক্টর স্কিম) এবং কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত প্রকল্প (সেন্ট্রালি স্পনসর্ড স্কিম বা সি এস এস) মারফত। বিভিন্ন রাজ্যে নানান সি এস এস প্রকল্প চলে, কিন্তু ছড়ি ঘোরায় কেন্দ্র। আমরা এই ব্যবস্থাটাকে রদ করতেই চাই, কিন্তু সেটা রাতারাতি করা কঠিন। তাই আমরা ঘোষণা করছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সমস্ত সি এস এস প্রকল্প রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
এ বার আসি মূল বাজেটে। প্রথমে জমার হিসেব, তার পর খরচের। শুরু করি মূলধনী খাতের হিসেব দিয়ে। সরকার বাজার থেকে বেশি ধার নিলে সুদের হার বাড়ে, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে, ভোগব্যয় কমে। আমরা সরকারি ঋণের ঊর্ধ্বসীমা স্থির করেছি দু’লক্ষ কোটি টাকা। এখানে বলা দরকার, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার বেঁধে দেওয়ার নীতি আমরা ইতিমধ্যেই রদ করেছি। ডাকবিভাগ যে সব সঞ্চয় প্রকল্প চালায়, সেগুলির সুদের হার ওই বিভাগই স্থির করবে। তেমনই পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদের হার ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক।
এ বার বেসরকারিকরণ। বিলগ্নিকরণের ঢাকঢাক গুড়গুড় নয়, একটু একটু করে দ্বিধাভরে সরকারি শেয়ার বিক্রি নয়, সাহসী, খোলামেলা বেসরকারিকরণ। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার অধিকাংশ শেয়ার আমরা বিক্রি করব। বেসরকারিকরণের জন্য নির্ধারিত সংস্থাগুলির তালিকা পরে প্রকাশ করা হবে, তবে এখানে জানিয়ে রাখি, আমরা এ বছরে সরকারি সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে মোট এক লক্ষ কোটি টাকা তুলব। কোল ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে, তবে আইন পরিবর্তনের জন্য সময় লাগবে। আমার কোনও সন্দেহ নেই যে, এই সিদ্ধান্তের প্রবল সমালোচনা হবে। বলা হবে, আমি পারিবারিক সম্পত্তি বেচে দিচ্ছি। কিন্তু লোকসানে চলা ৬৪টা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জন্য বছরে সরকার বছরে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ঢেলে চলবে, এর কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। এর পরেও যে সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সরকারি হাতে থাকবে, সেগুলিকে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হবে। এ বার প্রত্যক্ষ কর। আমরা নীতিগত ভাবে সেস এবং সারচার্জের বিরোধী। তাই শিক্ষা সেস বাতিল করছি, সমস্ত সারচার্জও রদ হচ্ছে। কোম্পানি আয়ের ওপর করের হার হবে ৩০ শতাংশ। ব্যক্তিগত আয়করের ক্ষেত্রে বার্ষিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে না, ৫ থেকে ১০ লাখ অবধি ১০ শতাংশ কর ধার্য হবে, ১০ থেকে ২০ লাখ অবধি ২০ শতাংশ, তার ওপর ৩০ শতাংশ। কৃষকদের কৃষিবহির্ভূত আয়ের ওপরেও কর ধার্য হবে। আমরা বিশ্বাস করি, আয়কর মানে আয়ের ওপর কর। তাই গিফট ট্যাক্স এবং সম্পদ কর বাতিল হচ্ছে। এখানে একটা কথা পরিষ্কার বলে দিতে চাই। অতীতের আয়ের ওপর কোনও ধরনের কর প্রয়োগ করা হবে না, অর্থাৎ ‘রেট্রোস্পেকটিভ ট্যাক্স’ নৈব নৈব চ। প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ব্যবস্থা আমূল সংস্কারের জন্য দ্রুত আইনি পদক্ষেপ করা হবে। আমরা এটা নিশ্চিত করতে চাই যে, করদাতাকে অপরাধী হিসেবে দেখা হবে না।
পরোক্ষ কর নিয়ে খুব কম কথাই বলার আছে। আমদানি শুল্কের কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন করছি না, কারণ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তির সঙ্গে আমদানি শুল্কের সম্পর্ক আছে। যেখানে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শুল্কের সঙ্গে ভারসাম্য রাখা দরকার, তেমন প্রয়োজন ছাড়া আমদানি শুল্কের ওপর কোনও সারচার্জ বা সেস থাকবে না। সর্বোচ্চ শুল্কের হার হবে দশ শতাংশ, সমস্ত ক্ষেত্রে পণ্যের দামের ওপর শুল্ক হিসেব করা হবে। রফতানির হাল ভাল নয়, তাই আপাতত আমদানি শুল্কের কোনও ছাড় রদ করা হচ্ছে না। তবে এগুলি ভবিষ্যতে পুনর্বিবেচনা করা হবে।
অভ্যন্তরীণ শুল্কের ক্ষেত্রে গোটা দেশে একটি অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জি এস টি) চালু করা জরুরি। পেট্রোলিয়মজাত পণ্য, মদ এবং তামাককেও এই জি এস টি’র আওতায় আনা উচিত। কিন্তু এ বছর সেটা করা সম্ভব নয়, ২০১৫-১৬ সালের বাজাটে এটা চালু করার চেষ্টা করব। কিন্তু এই পণ্যগুলি বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে ১২ শতাংশ জি এস টি চালু হচ্ছে। আশা করি, এর ফলে ভোগব্যয়, বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের বৃদ্ধি উৎসাহ পাবে। তবে, প্রত্যক্ষ করের মতোই এ ক্ষেত্রেও সমস্ত ছাড় ও রেহাই রদ করা হচ্ছে। রাজ্যগুলি তাদের আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হতে পারে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সমস্ত সম্ভাব্য লোকসান কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে পুষিয়ে দেওয়া হবে।
আয়ের পরে ব্যয়। বিভিন্ন খাতে ব্যয়বরাদ্দের তালিকা দাখিল করে সময় নষ্ট করব না, সমস্ত হিসেব বাজেটের নথিপত্রে দেওয়া আছে। শুধু একটা কথাই বলব। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে দুটি বিষয়ে ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে: প্রতিরক্ষা ব্যয় এবং মূলধনী ব্যয়। আর্থিক উন্নয়ন এবং দেশের নিরাপত্তার ভিত্তি জোরদার করাই এই বাজেটের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।
আমরা আশা করছি, ২০১৫-১৬ সালে আয়বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশে পৌঁছবে। ২০১৪-১৫’য় ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। মূল্যস্ফীতির গতিও হঠাৎ কমবে না, ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে আনাই আমাদের কাজ। আমাদের লক্ষ্য ২০১৪-১৫ সালে রাজস্ব ঘাটতি জিডিপি’র ১.৩ শতাংশে এবং রাজকোষ ঘাটতি ৩.৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। পূর্ববর্তী সরকারের বেলাগাম খরচের ফলে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তাতে এটাই রীতিমত কঠিন কাজ। বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সেই সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বাঁধা গতে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা কাজের মধ্যে দিয়েই নিজেদের সামর্থ্য ও সদিচ্ছা প্রমাণ করতে চাই।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.