স্বর্গের দরজা খুলিবার একটি চাবি আছে, সেই চাবি দিয়াই নরকের দরজা খোলা যায়। প্রাচীন প্রবচনের নূতন দৃষ্টান্ত রচনা করিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। রাজনীতির প্রচলিত পথে না হাঁটিয়া নিজস্ব রাজনীতির সংজ্ঞা নির্মাণ করিয়াছিলেন তিনি এবং অমিত সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার স্বাতন্ত্র্য প্রশ্নাতীত। সাত সপ্তাহের মুখ্যমন্ত্রিত্বও সেই প্রশ্নাতীত স্বাতন্ত্র্যের চলমান অভিজ্ঞান হইয়া থাকিল এবং শেষ পর্যন্ত কিছু খুচরো তামাশা ও উদ্বেগজনক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া বেঘোরে শেষ হইয়া গেল। তাহার অর্থ এই নয় যে, অরবিন্দ কেজরীবাল ও তাঁহার আম আদমি পার্টির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অন্ধকার। বস্তুত, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তাঁহারা যদি, কেবল দিল্লি নয়, হরিয়ানা বা পঞ্জাবের মতো রাজ্যে এবং বৃহত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে সাফল্যের পরিধি এবং গভীরতা বিস্তার করেন, বিস্ময়ের কিছু নাই। এই সমালোচনাও অহেতুক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না যে, সেই বৃহত্তর সাফল্যের তাগিদেই কেজরীবাল ও তাঁহার উপদেষ্টারা সচেতন ভাবে, পরিকল্পিত ভাবে দিল্লির কুর্সি ছাড়িয়া দিলেন, যাহাতে ষোলো আনা ‘বিরোধী’ হইয়া লড়িতে পারেন ও ‘শহিদ’ সাজিয়া বাড়তি সহানুভূতি কুড়াইতে পারেন। আবার, ইহা সত্য হইলেও সমালোচনাই করিতে হইবে, এমন বাধ্যতাও নাই রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প, সম্ভাবনা নির্মাণেরও। আম আদমি পার্টির সম্ভাবনা নির্মাণ এখনও চলিতেছে, না চলিলে ভারতীয় জনতা পার্টি একটি নিতান্ত সীমিত প্রতিপক্ষের প্রতি ক্রুদ্ধ বিষোদ্গারে এতটা শক্তি খরচ করিত না। কিন্তু ভবিষ্যৎ ক্রমশ প্রকাশ্য। আপাতত হাতে রহিয়াছে ঊনপঞ্চাশ বায়ু তাড়িত ঊনপঞ্চাশ দিনের অভিজ্ঞতা। দিশাহীন অশাসনের অভিজ্ঞতা। অরবিন্দ কেজরীবাল নিজেকে যে মহৎ অর্থেই নৈরাজ্যবাদী বলিয়া থাকুন, তাঁহার সরকার অতি ক্ষুদ্র এবং স্থূল অর্থে নৈরাজ্য চালাইয়া বিদায় লইয়াছে। অত্যুৎসাহী ‘পারি কমিউন’ স্মরণ করিতে পারেন, কিন্তু তাহা অতি উৎসাহের পরিচায়ক মাত্র। মহামতি মাও জে দং ঠিক বলিয়াছিলেন: সব মরণ নয় সমান।
এই পরিণতি কি অনিবার্য ছিল? অস্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জমিয়া ওঠা নাগরিক অসন্তোষকে পুঁজি করিয়া ক্ষমতায় আসিবার পরে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন সরবরাহের একটি আন্তরিক চেষ্টা করিতে গেলে কি নৈরাজ্যই ডাকিয়া আনিতে হয়? কখনওই নয়। আম আদমি পার্টির সরকার, মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা যে সব নিদর্শন রাখিয়াছেন, তাহা স্বচ্ছতার নয়, অনাচারের, বিশৃঙ্খলার। মুখ্যমন্ত্রীর আবাসে জনতার দরবার বসাইয়া তুমুল হট্টগোল এবং পত্রপাঠ দরবার প্রত্যাহার, দিল্লি পুলিশের শাস্তি চাহিয়া ‘ধর্না’, আফ্রিকান নাগরিকদের উপর আইনমন্ত্রীর চড়াও হওয়া ও পুলিশকে অন্যায় হুকুম দেওয়া, ‘গ্যাস কেলেঙ্কারি’র অভিযোগ লইয়া অপ্রয়োজনীয় অতিনাটক, শেষে জনলোকপাল বিল পেশ করার পদ্ধতিগত বিবাদ মাত্র কয়েক সপ্তাহে এমন অজস্র নজির তৈয়ারি হইয়াছে। শাসনতন্ত্রের নীতি এবং রীতি না মানিয়া অবিমৃশ্যকারী আচরণের নজির। ইহাকে খোলামেলা প্রশাসন বলে না, ইহা কুশাসন। বস্তুত, এমন অবিবেচক আচরণ খোলামেলা প্রশাসনের ক্ষতি করে, কারণ ইহাতে নাগরিকের মনে ধারণা হয়, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাস্তবে সম্ভব নয়, যাহা চলিতেছে তাহাই বরং ভাল, সরকারকে জনসাধারণের কাছে আনিয়া কাজ নাই। অরবিন্দ কেজরীবালরা সামাজিক ক্ষোভের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে রাজনীতির কেন্দ্রে আনিয়া ভারতীয় গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহারা না থাকিলেও এই বিষয়গুলিকে আর অগ্রাহ্য করা যাইবে না, সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই সেগুলির মোকাবিলা করিতে হইবে, ইতিমধ্যেই হইতেছে। ইহা সুলক্ষণ। কিন্তু আম আদমি পার্টিকে স্থির করিতে হইবে, তাহারা এই সমৃদ্ধির শরিক হইবে, না কি নিছক তাহার অনুঘটক হইয়াই থাকিয়া যাইবে। |