মাটিতে অম্লত্ব, ফলনে সঙ্কট জেলা জুড়ে
স্যগোলা হিসেবে পরিচিত বর্ধমানের মাটির স্বাস্থ্যই বেহাল।
জেলা কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ী জেলার ৩৩টি ব্লকের মধ্যে ২৫টির মাটিতেই ধরা পড়েছে অম্লত্ব। ফলে উর্বরতা কমছে ব্যাপক হারে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, চাষিদের সচেতন করতে শীঘ্র বড় ধরণের উদ্যোগ না করা হলে ‘শস্যগোলা’য় বিপর্যয় নামতে দেরি হবে না।
সম্প্রতি ২০১৩-১৪ সালের জেলা বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে একটি পুস্তিকা বের করে জেলা কৃষি দফতর। সেখানেই ২৫টি ব্লকের মাটিতে অম্লত্ব মেলার কথা বলা হয়। বাকি ৮টি ব্লকের মধ্যে পাঁচটিতে মাটিত চরিত্র স্বাভাবিক। আউশগ্রাম ১, আউশগ্রাম ২ ও জামালপুর ব্লকের মাটি অম্ল ও স্বাভাবিকের মাঝামাঝি। মাটি অম্ল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জৈব কাবর্নের পরিমাণ কমে আসার কথাও বলা হয়েছে ওই রিপোর্টে। জেলার সমস্ত ব্লকের মাটিতেই কমবেশি জৈব কাবর্নের অভাব রয়েছে।
কিন্তু যে জেলার অধিকাংশ মানুষের ভরসা জমি সেখানেই মাটির এমন হাল কেন? বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় তিনটি কারণ সামনে এসেছে। প্রথম, অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ। এছাড়া জৈব সারের প্রয়োগ কমিয়ে দেওয়া ও সারা বছর ধরে বিরামহীন চাষও মাটিতে অম্লত্ব বাড়ার কারণ। বিশেষজ্ঞেরা জানান, জেলায় সবথেকে বেশি ধান ও আলু চাষ হয়। প্রতি বছরই ফলন বাড়াতে রাসায়নিক সারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন চাষিরা। ফলে ধান, আলু উৎপাদনের ব্লকগুলিতেও জৈব কাবর্নের পরিমাণ কমে আসছে।
হারিয়ে যাচ্ছে উপকারী জীবাণুও। কালনা মহকুমা কৃষি দফতরের সহ-কৃষি অধিকর্তা নিলয় কর বলেন, “মাটির উপকারী জীবাণু বেঁচে থাকে জৈব কাবর্নের উপর নির্ভর করে। যে ব্লকগুলিতে সব্জি চাষ হয়, রাসায়নিক সার কম প্রয়োগ হওয়ায় সেখানে জৈব কাবর্নের পরিমাণ ভাল। মাটি যত অম্ল হচ্ছে তত হারিয়ে যাচ্ছে উপকারী জীবাণু।” আরেক সহ-কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ জানান, মাটি অম্ল হয়ে গেলে ফসফেট, পটাশ, জিঙ্কের মতো রাসায়নিক সারের একটা বড় ভাগ মাটিতে আবদ্ধ হয়ে যাবে। ফলে গাছ প্রয়োজনীয় খাবার পাবে না। ফলে একদিকে গাছের বৃদ্ধি কমবে, অন্যদিকে কমতে পারে ফসলেরও পরিমাণও। তাঁর দাবি, বারবার শিবির করে বলা সত্ত্বেও চাষিদের বেশিরভাগই মাটি পরীক্ষা না করে চাষাবাদ করেন। কোনও বছর ফসল কম হলে পরের বছর স্বাভাবিক ভাবেই সারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন তাঁরা। ফলে দু’দিক থেকেই ক্ষতি হয়। একদিকে চাষের খরচ বাড়ে, অন্যদিকে মাটিতে অম্লত্ব বেড়ে হ্রাস পায় উর্বরতা।
দু’দশক আগেও বর্ধমানে চাষিদের ঘরে ঘরে ভরসা ছিল হাল-বলদ। পরে ট্রাক্টর ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রাংশ আসায় বলদ রাখার রেওয়াজ এখন প্রায় নেই। ফলে কমে গিয়েছে জৈব সারের যোগানও। বিশেষজ্ঞদের দাবি, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ আর জৈব সারের ঘাটতি, এই দুই মিলেই মাটির এমন দশা। এছাড়া একই জমিতে ক্রমাগত চাষ চলতে থাকায় মাটির মধ্যে পর্যাপ্ত বাতাস ঢুকতে পারে না। অনেকে আবার চুন ছড়িয়ে চাষ শুরু করেন। তবে পার্থবাবুর দাবি, চুন ছড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে চাষ করলে বেশিরভাগ সময়েই লাভ হয়না। জমিতে চুন ছড়ানোর পরে অন্তত পনেরো দিন বিশ্রাম দিতে হয়।
মাটিতে অম্লত্ব বাড়ার পিছনে চাষিদের অসচেতনতাকে দায়ি করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের দাবি, জেলার একটা বড় অংশের কৃষকেরা বংশ পরম্পরায় একই জমিতে একই ধরণের ফসলের চাষ করেন। ফলে মাটির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। একথা স্বীকার করছেন চাষিরাও। মন্তেশ্বরের চাষি রবিউল মোল্লা জানান, সারা বছরই পালা করে জমিতে ধান চাষ করা হয়। তাতে লাভ-লোকসান যাই হোক, বিক্রি করা নিয়ে ঝামেলা হয় না। মেমারি ২ ব্লকের আলু চাষি খোকন ঘোষের কথায়, “শীত কালে আলু ছাড়া অন্য কিছু চাষের কথা ভাবিই না। বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই এমনটা চলছে।” অথচ চাষিদের বিকল্প চাষে উৎসাহিত করা, মাটি পরীক্ষা করে চাষ করা-সহ নানা ধরনের আধুনিক চাষ নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে জেলা, মহকুমা ও ব্লক পর্যায়ে নানা শিবির করা হয়। জেলার এক কৃষি কর্তা বলেন, “শিবিরে খুব একটা লাভ হয় না। বেশিরভাগ চাষিই মাটি পরীক্ষা না করে চাষাবাদ করেন। ব্লকে ব্লকে কৃষিমেলার আসর বসে। সেখানেও চাষ নিয়ে নানা সচেতনতামূলক আলোচনা হয়। তাতেও তেমন ফল মেলে না।
অম্ল মাটি চাষের পক্ষে বিপজ্জনক বলেই মত বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদেরও। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক কৌশিক ব্রহ্মচারী জানান, বর্ধমানে অতিরিক্ত চাষের জন্য মাটিতে অম্লত্ব বাড়ছে। তাঁর দাবি, গাছের বৃদ্ধির জন্য ১৭টি খাদ্য উৎপাদন লাগে। অম্লত্বের কারণে ফসফেট, পটাশ, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়ামের মতো কয়েকটি অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদান গাছ পায় না। চাষিরা সাবধান না হলে বিপদ বাড়বে। আরেক অধ্যাপক তপনকুমার মাইতি বলেন, “অম্লত্বের কথাটা জানি না। তবে বহু দিন ধরেই বলছি যে, চাষে যদি এ রাজ্যে বিপর্যয় নামে তাহলে তা শুরু হবে বর্ধমান ও হুগলিতে। কারণ এই দুই জেলার চাষিরা অত্যাধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন।” কালনার সহ-কৃষি অধিকর্তা নিলয়বাবু জানান, অম্লত্ব বাড়ায় রাসায়নিক মাটি আটকে রাখছে। ফলে তা গাছে পৌঁছচ্ছে না। বাড়ছে জীবাণুর প্রভাবও। ফলে ফসলে রোগ-পোকার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শিকড় ফোলা ইত্যাদি রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে।
তাহলে নিদান? কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রথমেই চাষিদের ধারাবাহিক ভাবে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে। সেক্ষেত্রে মাটির নমুনা পাঠাতে হবে ব্লক কৃষি দফতরে, সেখান থেকে তা যাবে জেলা মাটি পরীক্ষাগারে। বিনামূল্যে পরীক্ষার পরে রিপোর্ট কার্ড পাঠিয়ে দেওয়া হবে চাষিদের। তাতে মাটির চরিত্র কেমন, কোন কোন ফসল ফলানো যায় তার খুঁটিনাটি দেওয়া থাকবে। রিপোর্ট পাওয়ার পরে চুন বা ডলোমাইট দিয়ে জমি শোধন করতে হবে। নিলয়বাবু বলেন, “মাটি শোধনের জন্য অনেকেই জমিতে চুন দেন। তবে রিপোর্ট অনুযায়ী দেন না। ফলে তা ঠিকঠাক কাজে আসে না।” এর সঙ্গেই জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে জৈব সার, জীবাণু সার, কেঁচো সার, খামারজাত সার এবং সবুজ সারের পরিমাণ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাজার থেকে জীবাণু সার কেনার পাশাপাশি চাষিদের খামারজাত সার তৈরিতে জোর দিতে হবে। বাড়িতে থাকা জৈব পদার্থ গর্তে ফেলে রেখে সার তৈরি করতে হবে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিকবাবু জানান, জৈব সারের প্রয়োগ অম্লধর্মী ও ক্ষারধর্মী দু’ধরণের মাটিকে প্রশমিত করে। সবুজ সার প্রয়োগেও জোর দিয়েছেন তিনি। সেক্ষেত্রে ফসলের ফাঁকে ফাঁকে চাষ করতে হবে। ৬ সপ্তাহের সবুজ পুষ্ট ধনচে গাছকে জমির সঙ্গে মেশাতে হবে। কারণ ধনচে গাছের শিকড়ে নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী জীবাণু থাকে, যা বাতাসের নাইট্রোজেনকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এছাড়া অম্ল মাটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে চাষে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। সারা বছরই বিভিন্ন চাষের মাঝে ডাল শস্য চাষ করলে মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
জেলার মুখ্য কৃষি অধিকর্তা তথা ডেপুটি ডিরেক্টর শ্যামল দত্ত ও চুন দিয়ে জমি শোধনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি জানান, মাটি পরীক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষার গাড়ি বাড়াতে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের তরফে মাটি পরীক্ষা করে চাষ করার ব্যাপারে শিবির করেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জেলার এক কৃষিকর্তা বলেন, “চাষিদের সচেতন করার প্রয়াসই যথেষ্ট নয়, সয়েল কার্ড করার ব্যাপারে বাধ্যতামূলক নিয়ম চালু করা প্রয়োজন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.