পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্তে হাইকোর্ট যেখানে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়ে দিয়েছে, সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ওই মামলায় অভিযুক্ত তালিকায় এক নম্বরে থাকা অনুব্রত মণ্ডলের পাশে দাঁড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, “কেষ্ট (অনুব্রত) এক জন ভাল সংগঠক। কেউ কেউ ওর পিছনে লাগে। এক জন ভাল সংগঠকের জন্য শেষ শক্তি পর্যন্ত থাকব।”
শনিবার দুর্গাপুরে দলের যুব, যুবা ও ছাত্রদের নিয়ে এক কর্মশালায় মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের পরেই বিতর্ক বাধে। পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যা মামলার অন্যতম অভিযোগকারী তথা নিহতের পূত্রবধূ শিবানী ঘোষ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুব্রত মণ্ডল ভাল লোক হতে পারেন। কিন্তু এই অঞ্চলে এবং আমার পরিবারের কাছে অনুব্রত ভাল লোক নন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ঠিক তথ্য পৌঁছয়নি, তাই তিনি এমন কথা বলছেন।” আর বাম-কংগ্রেস-বিজেপি-সহ বিরোধীরা প্রায় একই সুরে বলতে শুরু করে, “অরাজকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী এমন বললে নিরপেক্ষ তদন্ত করাই তো সিট-এর পক্ষে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।”
‘সিট’, পাড়ুই মামলা বা আদালতের উল্লেখ অবশ্য এ দিন করেননি তৃণমূল নেত্রী। দলের কর্মীদের ‘সব সময় কাজ করে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা’ বোঝাতে গিয়েই মঞ্চের সামনের সারিতে বসে থাকা দলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রতর নাম টানেন তিনি। মমতা বলেন, “ও ভাল কাজ করে আমি জানি। কেষ্ট এক জন ভাল সংগঠক।” এর পরেই আসে অনুব্রতর জন্য ‘শেষ শক্তি পর্যন্ত’ থাকার প্রসঙ্গ। |
মমতার দরবার। শনিবার দুর্গাপুরে দলীয় কর্মিসভায় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম। |
রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল নানা সময় নানা মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছেন। তাঁর সেই বিতর্ক-প্রবণতার একটা ব্যাখ্যাও এ দিন মিলেছে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। মমতার কথায়, “আপনারা হয়তো জানেন, উনি খুব বেশি সুস্থ নন। ওঁর একটা সমস্যা আছে। ওঁর শরীরে অক্সিজেন কম যায়। ওঁকে অক্সিজেন নিয়ে ঘুরতে হয়। আমাদের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। মানবিক ভাবে দেখতে হবে।” খোদ অনুব্রত বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যা বলে দিয়েছেন, তার পরে আমার আর কোনও কথা বলার অধিকারই নেই।”
গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে পাড়ুইয়ে গিয়েই প্রথম বিতর্কে জড়ান অনুব্রত। সেখানকার কসবা এলাকায় এক কর্মিসভায় তিনি বলেন, “কসবায় যদি কোনও নির্দল প্রার্থী কারও বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়, তার বাড়িটা ভেঙে জ্বালিয়ে দিন। যদি প্রশাসন ভাবে সেই নির্দলকে সমর্থন করবে, তা হলে সেই প্রশাসনের পুলিশের উপরে বোম মারুন।” ১৭ জুলাই অনুব্রতর সেই বক্তৃতার পরে কসবা অঞ্চলে একাধিক নির্দল (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) প্রার্থীর বাড়িতে বোমাবাজি হয়। বীরভূমে পঞ্চায়েত ভোটের আগের দিন, ২১ জুলাই রাতে খুন হন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ।
কলকাতা হাইকোর্ট শুক্রবারই বলেছিল, পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অফিসার দরকার। সে জন্যই সিআইডি তদন্ত চালানো সত্ত্বেও ডিজি-কে মাথায় রেখে ‘সিট’ গড়া হয়েছে হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে। এমন পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী এ দিন অনুব্রতর পাশে দাঁড়ানোয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্ত সম্ভব নয় বলেই অভিযোগ বিরোধীদের। |
|
কেষ্ট (অনুব্রত) এক জন ভাল সংগঠক।
কেউ
কেউ ওঁর পিছনে লাগে।
এক জন ভাল
সংগঠকের
জন্য শেষ শক্তি পর্যন্ত থাকব।
ওঁর (অনুব্রতর) শরীরে অক্সিজেন কম যায়।
ব্যাপারটা মানবিক
ভাবে দেখতে হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,
মুখ্যমন্ত্রী |
|
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, “ভাল সংগঠক হলে পুলিশকে বোমা মারতে নির্দেশ দেওয়া যায়! বিরোধীদের ঘর জ্বালাতে বলা যায়! নির্দল প্রার্থীকে খুন করতে বলা যায়! এটা এখন বোঝা গেল!” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ আবার বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর দল এখন মস্তান-নির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই উগ্র অনুগামীদের মদত দিচ্ছেন তিনি।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মতে, “তৃণমূল নেত্রী যখন দলীয় মঞ্চ থেকে কিছু বলেন, তখনও কিন্তু তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ফলে, পুলিশ-প্রশাসনের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা যায়, অনুগত কাউকে গ্রেফতার কোরো না! দলের নেতার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত লড়ব! মানে, মুখ্যমন্ত্রী চান না, ব্যবস্থা নেওয়া হোক!”
বিতর্কিত নেতার পাশে দল দাঁড়িয়েছে, এমন উদাহরণ অবশ্য আগেও দেখেছেন রাজ্যবাসী। ছোট আঙারিয়ার ঘটনার সময় তৎকালীন শাসক দলের অভিযুক্ত দুই নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলিকে ‘দলের সম্পদ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। দমদমে জোড়া খুনে অভিযুক্ত নেতা দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে একই বিশেষণে ভূষিত করেন সিপিএমের কলকাতা জেলার নেতা রাজদেও গোয়ালা। আবার ভাঙড় কলেজে অধ্যাপিকাকে জলের জগ ছুড়ে মারায় অভিযুক্ত প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলামকে ‘তাজা নেতা’ বলে তাঁর পাশে দাঁড়ান তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। পাড়ুইয়ের ঘটনায় অনুব্রতর পক্ষ নিয়ে এর আগে বিধানসভাতেও মুখ খুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
অভিযুক্ত নেতাদের মাথার উপরে শাসক দলের নেতৃত্বের বরাভয়ের সেই পরম্পরাই এখনও চলছে বলে রাজনৈতিক শিবিরেরই একাংশের মত। তবে সিপিএম নেতৃত্বের যুক্তি, কোনও ঘটনায় কিছু নেতা অভিযুক্তদের পাশে রাজনৈতিক ভাবে দাঁড়িয়েছেন ঠিকই। তবে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী কখনওই তাঁদের হয়ে সওয়াল করেননি। বরং, দমদম-কাণ্ডে দলের একাংশের বাধা উপেক্ষা করেই দুলালকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেলিমের কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী এর আগে ধনেখালি-কাণ্ডে তৃণমূল বিধায়ক অসীমা পাত্র, ভাঙড়ে আরাবুল ইসলাম বা রায়গঞ্জে কলেজের ঘটনায় তিলক চৌধুরীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূলের ভাল সংগঠক তাঁরাই, যাঁরা অপরাধ সংগঠিত করতে পারেন!” অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “সামনে লোকসভা ভোট। অনুব্রতর মতো নেতাদের গ্রেফতার করা হলে ওঁরা (তৃণমূল) ওই জেলায় ভোট করবেন কী ভাবে?”
ভোটের আগে দলের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, “রাজনীতি মানে ত্যাগ, আত্মবলিদান, শৃঙ্খলা। ‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’।” কর্মীদের প্রতি তাঁর পরামর্শ, “মাথা উঁচু করে চলতে হবে। আমার কাজ গুন্ডামি করা নয়, গুন্ডামি-বদমায়েশি আটকানো। মানুষের জন্য
কাজ করুন। দলে সম্মান পাবেন। রাজনীতি করি বলে গায়ের জোর দেখালে হবে না। ভাল ভাবে কথার মাধ্যমে কাজ করতে হবে।”
তৃণমূল নেত্রীর হুঁশিয়ারি, “আমরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। দল যেমন পজিশন দেয়, তেমনই পজিশন ছিনিয়ে নিতেও পারে। মনে রাখবেন, দল সব নজর রাখছে।”
এ দিকে, সাগর ঘোষ হত্যা মামলার তদন্তে এ দিন সকালেই ‘সিট’-এর তিন প্রতিনিধি যান সিউড়িতে সিআইডি-র দফতরে। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে মামলা সংক্রান্ত নানা কাগজ পরীক্ষা করেন তাঁরা। সন্ধ্যায় তাঁরা যান বাঁধ নবগ্রামে, সাগর ঘোষের বাড়িতে। সেখানে বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সাগরবাবুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। খুনের দুই প্রত্যক্ষদর্শী সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী ও পুত্রবধূ শিবানীদেবীকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন। তবে বিষয়টি নিয়ে তদন্তকারীরা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পরে সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষ বলেন, “এ রাজ্যে এখনও অনেক সৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসার রয়েছেন। তাঁরা কারও বক্তব্যে প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করবেন বলেই আশা রাখছি।”
এ দিনই রাজ্য মানবাধিকার কমিশন থেকে সাগরবাবুর বাড়িতে একটি চিঠি পৌঁছেছে। কমিশনের রেজিস্ট্রার রবীন্দ্রনাথ সামন্তের লেখা ওই চিঠিতে কমিশনের পক্ষ থেকে বীরভূমের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনার কাছ থেকে আগামী এক মাসের মধ্যে সাগরবাবুর খুন নিয়ে একটি রিপোর্ট তলব করা হয়েছে। জেলাশাসক অবশ্য জানান, ওই মর্মে এখনও কোনও চিঠি পাননি তিনি। |