|
|
|
|
|
|
|
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: সুচিত্রা সেন |
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য |
প্রতিবেদক: ফেসবুকে চ্যাংড়ারা লিখছে, অ্যাদ্দিনে আপনি ‘অফিশিয়ালি’ মারা গেলেন।
সুচিত্রা: মানে!
প্রতি: যে লোকটা তিরিশ বছর ধরে ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে, সে তো লাইফে পার্টিসিপেটই করল না!
সুচিত্রা: আমি আমার লাইফ কী ভাবে কাটাব, সেটা অগা জনতার কাছ থেকে অ্যাটেস্ট করিয়ে নিয়ে আসব নাকি! আমি সম্রাজ্ঞী। আমার টার্মসে আমার জীবন চালিয়েছি। সাধারণ মানুষ যা কল্পনাও করতে পারবে না, তা আমি অনায়াসে করি। তাই আমি সুচিত্রা সেন।
প্রতি: সেটাই বলছি ম্যাডাম, আপনি অ-সাধারণ হওয়ার ট্র্যাপে এমন করে পড়ে গেলেন, হাঁটতে হাঁটতে চৌমাথা গিয়ে ফুচকা খাওয়ার সুখ কোনও দিন পেলেন না, হইহই করে ঠাকুর দেখতে যেতে পেলেন না...
সুচিত্রা: ও সব ছোট ছোট সুখ দিয়ে আমার কী হবে? আমি কি পাবলিক? একটা কেরানি? আমার জীবনের কাছে আমার ডিম্যান্ড আকাশছোঁয়া, তাই আমার স্যাক্রিফাইসও অতিমানবিক। যে বড় লেখক হয়, সে তোদের মতো সাড়ে ন’টা অবধি বিছানায় গড়ায় না। ভোর চারটেয় উঠে লিখতে বসে যায়। দিনের পর দিন না খেয়ে না দেয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে নিজেকে আসুরিক কষ্ট দিয়ে মণিমাণিক্য হেঁচড়ে আনে। অন্যের পুজো পেতে গেলে নিজেকে নিরন্তর ছাপিয়ে যেতে হয়। নিজেকে নিংড়ে সাধনা চালিয়ে যেতে হয়। আমার জীবনই আমার সাধনা। কাকে বলে মহানায়িকা, সেটা আমি শুধু সিনেমায় অভিনয় করে বোঝাইনি। আমার প্রতিটি দিন অসাধারণ ভাবে যাপন করে বুঝিয়েছি।
প্রতি: উঁহু, আপনি নিজের জীবনটা যাপন করেননি, ফেলে-আসা সেলুলয়েডের শটগুলো যাপন করেছেন। ফ্ল্যাশব্যাকের মশারি টাঙিয়ে গোটা বর্তমানটাই ভুলে মেরে দিয়েছেন। সময়ের প্রিজনার!
সুচিত্রা: উলটো! সময় আমার প্রিজনার। সময় সব্বাইকে দুমড়েছে। তাবড় সুন্দরীর মুখে কুচ্ছিত ভাঁজ ফেলেছে। সেই সর্বশক্তিমান সময়কে আমি আমার প্রতিজ্ঞার লোহামুঠিতে আটকে রেখেছি। এখনও সুচিত্রা বলতে সেই সপ্তপদী, সেই চাওয়া-পাওয়া। কেউ আমার বুড়ো-মুখ দেখতে পায়নি। |
|
সুচিত্রা সেন ছবি তুলতে দেননি। |
প্রতি: এইটাকে কোনও ম্যাচিয়োর লোক সর্বোচ্চ ক্যালি ভাবতে পারে, সেটাই তো হাসির! বুড়ো-মুখ দেখলে কী এসে যেত? আপনার ফিল্মগুলো মুছে যেত? রজনীকান্ত্ তো টাকমাথা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছেন, ওঁর ঝাঁকড়াচুলো নায়ক-ইমেজ টাল খাচ্ছে? আসলে, বয়স হলে সময় থাবা বসাবে, এই চিরকালীন সত্যিটাকে মেনে নেওয়ার ধক আপনার ছিল না। বাঁচতে গেলে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা দরকার হয়। আপনার সেই ফ্যাকাল্টিটায় ডিফেক্ট।
সুচিত্রা: মেনে নেয় কারা? অসহায়রা। ভিতুরা। বোকারা। তারা ভাবতেও পারে না, না মেনে নেওয়াটাও, এমন পরাক্রান্ত জীবন-নিয়মের বিরুদ্ধে ফিরতি লড়াই দেওয়াটাও একটা অপশন হতে পারে। আর, একটু ভেবে দ্যাখ তো, তারাও সত্যি মেনে নেয় কি? টাক পড়ে গেলে তবে কোটি কোটি লোক চুল পুঁততে লাইন লাগাচ্ছে কেন? অ্যান্টি-এজিং ক্রিম লাখে লাখে বিকোচ্ছে কেন? আমি যদি বলি, এই পৃথিবীতে সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে আজ অবধি সবাই জানে বয়স হলে বুড়ো হতেই হবে, কিন্তু আজও কেউ, দেশে দেশে কালে কালে এক জন সিংগল পার্সনও, এটাকে মেনে নিতে পারেনি। শুধু নিরুপায় হয়ে সারেন্ডার করেছে। ভেতরে ভেতরে গুমরে কেঁদেছে। আমার মতো এক-আধটা লোক শুধু অবিশ্বাস্য মনের জোরে পাঞ্জা লড়েছে।
প্রতি: পাঞ্জায় জিতলেন কি? ভগবান তো মানুষের ভোগের জন্যে পৃথিবীতে আলো হাওয়া গাছ মাঠ, সমাজ সংসার সৃষ্টি করেছেন?
সুচিত্রা: আর সিনেমাটা ভগবান সৃষ্টি করেননি? সিনেমার চারপাশের রুপোলি হিপনোটিজ্ম? বিভিন্ন মানুষের হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে তিনি যে ‘চয়েস’ দিয়েছেন, সেগুলো তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নয়? আমি সেই চয়েস প্রয়োগ করেছি। বেছে নিয়েছি গ্ল্যামার। রহস্যময়তা।
প্রতি: আর জীবনটা বাছতে ভুলে গেছেন। আপনি বেছে নিয়েছেন মানুষ-সুচিত্রাকে নয়, চৌকোনা ফিল্ম-পরদায় ফুটে ওঠা সুচিত্রার ইমেজগুলোকে। বানানো রোলগুলোকে। ওইগুলোই যাতে ‘আপনি’ হয়ে থাকে, তা নিশ্চিত করতে নিজেকে অসহ্য নির্বাসন-কষ্ট দিয়েছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কয়েদির চেয়েও বেশি, কারণ সে তবু অন্যকে অভিশাপ দিয়ে কিছুটা হালকা হয়, আপনার সেই সুযোগও নেই।
সুচিত্রা: আরে গাধা, তুই যেটাকে কষ্ট বলে ভাবছিস, সেটা বৃহত্তর একটা আনন্দের কাছে তুচ্ছ হতে পারে, এটা তোর মোটা মাথায় ঢুকছে না। ঢুকছে না, কারণ, তুই যেটাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে লাফাচ্ছিস, তা আসলে ‘গড়’। অ্যাভারেজ। ভীষ্ম তো এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যা তাঁকে জীবনের একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক সুখ থেকে বঞ্চিত করেছিল। তাতে কি প্রমাণিত হয় উনি অ্যাবনর্মাল ছিলেন? না উলটোটা? ওঁর মনের জোরে উনি নর্মালদের চেয়ে অনেক ওপরে উঠেছিলেন? ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কথা শুনে কেউ হাসেনি, পুষ্পবৃষ্টি হয়েছিল।
প্রতি: ওই ‘পুষ্পবৃষ্টি’র ফাঁদটা ভয়াবহ। এই হাততালির আওয়াজের কাছে এক বার বিকিয়ে গেলে আর নিজের ইচ্ছের লাব-ডুপ’গুলো শুনতে পাওয়া যায় না। মানে, যায় অবশ্যই, কিন্তু না-পাওয়ার ভান করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকতে হয়। ভীষ্মের অসহ্য রাত্রিকান্নাগুলোর হিসেব ব্যাস দেননি। কিন্তু আন্দাজ করা যায়। নিজের রক্তমাংসের চেয়ে নিজের পোস্টারকে ভালবাসার খাজনা সাংঘাতিক।
সুচিত্রা: আদায়ও তুলনাহীন। আমি মারা যাওয়ার পরে তোদের মেগা-হাহাকারটা দেখলি? মারা যাওয়ার আগে তোদের মুখ্যমন্ত্রীর হাসপাতালে এসে বসে থাকাটা দেখলি? এই যে ইন্টারভিউ নিতে ছুটে এসেছিস, আর আমার সব অ্যাসপেক্ট বাদ দিয়ে শুধু এই একটা ব্যাপার নিয়েই ঘ্যাঁতরঘ্যাঁতর রেকারিং ডেসিমেলের মতো লেগে আছিস, তার কারণটা খতিয়ে ভেবেছিস? কারণ এই ‘চিরযৌবন’-এর যে আশ্চর্যতা, সেটা তোদের হন্ট করে। তোরা আকর্ষণের চোটে ছটফট করিস। সিদ্ধান্তটার রেলা-টা কল্পনা করেছিস? আমার কন্টেমপোরারি সবাই যেখানে সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন করে হাল্লাক, সেখানে আমার টোটাল রিফিউজালটা কী সাংঘাতিক!
প্রতি: সাংঘাতিক হত, যদি সেটা কোনও নীতি বা আদর্শ থেকে আসত। কিন্তু এসেছে তো ইনসিকিয়োরিটি থেকে, আর মিস্টিক ভ্যালুটা বাড়িয়ে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার লোভ থেকে।
সুচিত্রা: আরে মরণ, এই গোটা মিস্টিক জ্যোতিটা তো আমাকে ভেঙে আমার অমর ক্রিয়েশন!
প্রতি: ক্রিয়েশন বলবেন না। ‘না করা’ আবার ক্রিয়েশন কী করে হয়? ক্রিয়েট আপনি করতে পারতেন, যদি আপনার বয়সোপযোগী রোল লিখিয়ে সেই সব ফিল্মে অসামান্য অভিনয় করতেন। আপনার কন্টেমপোরারিরা বরং চেষ্টা করছেন। অতীতের ওপর বকলমা দিয়ে জীবন থেকে পালাননি। অভিনেত্রী বলতে ওঁরা শুধু ‘নায়িকা’ বোঝেন না, ‘চিরযুবতী’ বোঝেন না। আপনার সিদ্ধান্তটায় রেলা নেই, পরাজয় আছে। আত্মমুগ্ধতার কাছে পরাজয়। আপনি বাংলার সেরা নার্সিসাস। আপনিই সুচিত্রা সেনের উন্মাদতম ফ্যান।
সুচিত্রা: প্রত্যেকেই তাই। বিশ্বে কোন বান্দা আছে যে আপাদমাথা আত্মময় নয়? আমি সেটাকে ঢেকেচেপে না রেখে এমন সাংঘাতিক সাড়ম্বরে উদযাপন করেছি, সেই গাট্স-টা দেখে তোরা ঘাবড়ে যাস। আমি জীবনের কেন্দ্রে প্রকাণ্ড আয়না সেট করে, উদ্ধত ঘাড় বেঁকিয়ে নশ্বরতাকে বলতে পেরেছি: ও আমাকে টাচ করবে না! |
|
|
|
|
|