গাব্বুর আকাশ
গাব্বু মাঝে মাঝে ওদের পুরনো তিন তলা বাড়ির ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। গাব্বু ভাবে সূর্য অস্ত গেলে সেই গ্রহটা; সেই মঙ্গলগ্রহটাকে যদি খালি চোখে দেখা যায়। ভাবে, একটা টেলিস্কোপ থাকলে কাজটা কত সহজ হয়, কত মজার হয়। বহু মানুষ বলে মঙ্গলগ্রহতে নাকি জীবন আছে। সেখানে কি মানুষ আছে? তা হলে কি গান আছে, কবিতা আছে? সুখ আছে, আনন্দ আছে, আবার হয়তো দুঃখ আছে।
টেলিস্কোপে দেখা যায় এ গ্রহটার মাঝখানে বড় বড় গর্ত। এ গ্রহটি নাকি যুদ্ধের দেবতা, সেই রাজা পাগল নীরোর দেশের আরাধ্য দেবতা। যুদ্ধে যাওয়ার আগে সবাই নাকি এই গ্রহটাকে নমস্কার করে মনে মনে। এই গ্রহটা যখন পৃথিবীর একেবারে উল্টো দিকে থাকে বিশেষত অগস্ট মাসে, তখন পৃথিবীর সঙ্গে দূরত্ব হয় ৩৫ মিলিয়ন মাইল থেকে প্রায় ৬৩ মিলিয়ন মাইল। সূর্য থেকে এ গ্রহের দূরত্ব প্রায় ২৬ মিলিয়ন মাইল কখনও আবার বেশিও হয়। মঙ্গলগ্রহ, পৃথিবী ও সূর্য প্রায় একই সরলরেখার ওপর অবস্থিত। যদিও পুরোপুরি সরলরেখা নয়।
এ সব ভাবতে ভাবতে গাব্বু ছাদ থেকে নীচে নেমে এল। নীচে এসে গাব্বু ওর বাবাকে খুঁজতে লাগল। গাব্বুর বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। গাব্বু বাবাকে না পেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, মঙ্গলগ্রহের ব্যাস প্রায় ৪,২১৫ মাইল। পৃথিবীর ব্যাসের অর্ধেকের চাইতে একটু বেশি। ওজনটাও পৃথিবীর ওজনের দশ ভাগের এক ভাগ।’
গাব্বুর মা হেসে বললেন, ‘এ সব আমি বুঝি না, তোর বাবা বলতে পারবে।’
গাব্বু হেসে বলল, ‘গ্যালিলেও-র নাম শুনেছ তো! তিনি কিন্তু এ পৃথিবীরই মানুষ।’
—কেন শুনব না। বললেন গাব্বুর মা। একটু অবাক হয়েই কথাটা বললেন তিনি।
—গ্যালিলেও টেলিস্কোপ আবিষ্কার করার পর মঙ্গলগ্রহকে সুন্দর ভাবে দেখা গেল। পুরো না হলেও বিজ্ঞান কিছুটা বোধ হয় এগিয়ে গেল, বলল গাব্বু।
—বেশ তো, সে সব পরে হবে। তোর বাবা সবই জানে। গ্যালিলেও, শেক্সপিয়র এঁরাই তো ঈশ্বর। বলল গাব্বুর মা।
—সেই সময় টেলিস্কোপ যখন আবিষ্কার হয়েছে, তখন শেক্সপিয়র তাঁর নাটক নিয়ে দাপাদাপি করছেন। কিন্তু কিছু দিন বাদেই শেক্সপিয়র পৃথিবী ছাড়লেন। কিন্তু গ্যালিলেও বেঁচে ছিলেন। বলল গাব্বু।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
—বেশ, বুঝলাম। কী বলছিস বল। বলল গাব্বুর মা।
—কিছুই না। ভাবছি অদ্ভুত মহাকাশের কথা। বলল গাব্বু।
গাব্বু আর কথা বাড়াল না। গাব্বু শুধু ভাবল সে কোনও দিন কি মঙ্গলগ্রহে যেতে পারবে? আবার ভাবল মঙ্গলগ্রহটার নাকি ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, পরে জানা গেল ২৪ ঘণ্টা নয়। সেটা হল ২৪ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট। এখন আবার ২৪ ঘণ্টা সাড়ে সাঁইত্রিশ মিনিট। সব নতুন নতুন তথ্য। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আবার ভাবল এ গ্রহটার মাটি কি নরম না শক্ত? জল যদি থাকে, তবে প্রাণ কি আছে?
গাব্বুর বাবা বাড়ি ফিরতেই গাব্বু জিজ্ঞেস করল বাবাকে, ‘বাবা, দক্ষিণ ও উত্তর মেরু যেমন এখানে মানে পৃথিবীতে আছে, মঙ্গলগ্রহতেও উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু আছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার।’ গাব্বুর বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ, দুটো টুপির মতো টেলিস্কোপে দেখা যায়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সব বদলে যায়। উত্তরে গরমের সময় উত্তরের টুপিটাকে দেখা যায় না। তখন দক্ষিণ দিকের টুপিটা জেগে ওঠে। তো কী হয়েছে।
এ সব তো প্রকৃতির মজা। আবার ঠান্ডার সময় উত্তর দিকের টুপিটা জেগে ওঠে।’
—না। মানে! বলল গাব্বু।
—মানে আবার কী। পৃথিবীতে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে যেমন বরফ দেখা যায়, অনেকটা সেই রকম। টেলিস্কোপে চোখ রাখলেই এ সব দেখা যায়। বললেন গাব্বুর বাবা।
—চারিদিকে লালে লাল কী সব আছে। যেন মনে হয় ধু ধু প্রান্তর। বলল গাব্বু।
—বীরভূমের লাল মাটির মতো। তবে ওখানে সমুদ্র আছে বাদামি রঙের। আবার কোনওটা ছাই ছাই রঙের।
—সমুদ্র আছে!
—বিজ্ঞানীরা তাই তো বলছেন। দীর্ঘকাল ধরে বৈজ্ঞানিকদের চলছে এক সংগ্রাম। সেখানে কি প্রাণ আছে!
গাব্বু স্কুলে আসে। স্কুলের ক্লাসের সময়টা মাঝে মাঝে ক্লাসরুমের জানলার ভেতর দিয়ে গাব্বুর মনটা আকাশে উড়ে চলে যায়। আকাশে ফাল্গুনের মেঘ। টিফিনের সময় গাব্বু ক্লাসের বন্ধু নয়নকে বলে মহাকাশের কথা, মঙ্গলগ্রহের কথা। নয়ন অবাক হয়ে গাব্বুর কথা শোনে। নয়ন জিজ্ঞেস করে মঙ্গলগ্রহের মানুষগুলো কেমন দেখতে? আমাদের মতো? নাকি দৈত্যের মতো?
গাব্বু বলে এখনও প্রমাণ হয়নি সে সব কিছু। বৈজ্ঞানিকরা আশাবাদী; আবার কেউ কেউ বলছে সেখানে প্রাণ নেই। কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। ঠিক জানা যাচ্ছে না।
—তবে? বলল নয়ন।
—বরফ গলে সেখানে জল তৈরি হয়। সেটাও মনে হচ্ছে। কিন্তু শুধু জলে উদ্ভিদ বাঁচে না। সূর্যের আলো দরকার।
—মজার ব্যাপার!
—মজার ব্যাপার বটেই। উদ্ভিদ জন্মায় কি না কেউ বলতেও পারছে না। জন্তু-জানোয়ারও নেই।
—তা হলে। সেটাই তো কথা। সত্যি গাব্বু কী আশ্চর্য এই মহাকাশের খেলা। কত রহস্য, কত মজা।
এ সব কথা যখন হচ্ছিল, তখন শুভঙ্কর, মলয়, সুব্রত ক্লাসের আরও দু’এক জন এসে গাব্বুকে ঘিরে ধরল। গাব্বুর কথা শুনে শুভঙ্কর বলল, ‘পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে। মঙ্গলগ্রহের কথা ভেবে ভেবে তুই পাগল হয়ে যাবি।’
গাব্বু বলল, ‘পাগল হওয়ার কী আছে। কোনও দিন কলকাতার আকাশটাকে দেখেছিস! ট্রাম, বাস, গাড়ি আর উঁচু উঁচু বাড়ির ওপরে আকাশটাকে দেখলে বুঝতে পারবি।’
মলয় বলল, ‘যত সব পাগলামি, পৃথিবী ছাড়া কোথাও কিছু নেই। সব মিথ্যে।’ সুব্রত কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাব্বুকে দেখতে লাগল।
ইস্কুল থেকে গাব্বু বাড়ি ফিরে এসে ছাদে চলে গেল। ধীরে ধীরে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে। গাব্বু ভাবল কোনও কিছুকে জানতে হলে পাগল হতে হয়। আইনস্টাইন পাগল ছিলেন, কিন্তু আজও দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তাল গাছের মতো। তিনি স্বমহিমায় বিরাজ করছেন বিজ্ঞানীদের মাথায়। আইনস্টাইন পাগল নন, প্রফেসর আইনস্টাইন, অঙ্কের দৈত্য আইনস্টাইন, ড. আলবার্ট আইনস্টাইন। পাগল পৃথিবীর কিছু মানুষ। এরা পৃথিবীর বড় বড় প্রতিভাকে পাগল ভাবে।
গাব্বু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পৌঁছে গেল সেই লালমাটির গ্রহতে। চারিদিকে লালের আভা, হঠাৎ গাব্বু দেখল কাতারে কাতারে মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ওদের মধ্যে এক জন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি পৃথিবীর মানুষ?’
গাব্বু বলল, ‘হ্যাঁ, কেন?’
ওরা সবাই বলল, ‘আমরা পৃথিবীতে যাব। দেখব সেখানকার মানুষজন কেমন!’
না। এ সব কিছুই ঘটেনি। গাব্বু ভাবছিল এ সব কথা। গাব্বু ভাবল সত্যি কি ওখানে লালমাটি আছে? পরক্ষণেই ভাবল এ সব কী সে ভাবছে? গাব্বু ছাদ থেকে নীচে নেমে এল। গাব্বুর মা বললেন, ‘কী রে, কোথায় ছিলি! ছাদে?’
গাব্বু বলল, ‘হ্যাঁ, ছাদে, মনটা ছটফট ছটফট করছিল। ভাবছিলাম মহান বৈজ্ঞানিক গ্যালিলেওর কথা।’
—তো সেখানে কী দেখছিলি? আকাশ? বললেন গাব্বুর মা।
গাব্বু হেসে বলল, ‘আকাশ নয়, মহাকাশ, রহস্যময় মহাকাশ।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.