স্বরূপগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে কলাতলার দিকে রিক্সায় সওয়ারি নিয়ে যাতায়াত করার ফাঁকে, এখনও তার নজর চলে যায় পথের ধারে। সেখানে ডাঁই হয়ে রয়েছে পুরু কাঠের ফ্রেমে, পোক্ত লোহাকাঠ দিয়ে তৈরি তাঁতের কঙ্কালসার কাঠামো। মন খারাপ হয়ে যায় গোপাল দেবনাথের। লোহা বিক্রি হয়ে গিয়েছে কারবারির কাছে, পড়ে আছে শুধু কাঠটুকু, তাও যে কোনও দিন খাটের পায়া কিম্বা আলমারির পাল্লা তৈরি হয়ে যাবে। এখনও কাঠের চওড়া ফ্রেমের গায়ে সিঁদুরের ঝাপসা দাগ একটু ভাল করে নজর করলেই চোখে পড়ে।
স্বরূপগঞ্জের রাস্তার দু’পাশে পড়ে রয়েছে অন্তত ডজন তিনেক তাঁত। তাঁতিরা সেই সব তাঁত বিক্রি করে দিচ্ছেন কাঠের ব্যবসায়ীদের কাছে। যে তাঁতের খটাখট শব্দে বোনা হত স্বপ্নের মতো শাড়ি, তোলা হত রকমারি নকশা, তার এক একটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ১২০০ - ৩৫০০ টাকায়। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যাচ্ছে একটা যুগের। তাঁত তো শুধু কাজের জিনিস ছিল না, ছিল ভালবাসার জিনিস। তিন পুরুষের তাঁতশিল্পী গোপালবাবুর মনে আছে, বছরের নানা উৎসবের সময়, বিশেষ করে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মা খুব যত্ন করে তাঁতের গায়ে আলপনা, সিঁদুর দিতেন। পরে তাঁর স্ত্রীও একই কাজ করতেন। জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হত।
আদরের সেই তাঁত এখন পড়ে রাস্তায়। গোপাল দেবনাথ নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর রাজ্য সড়কে রিকশা চালান। তাঁর মতো বহু তাঁতি জাতব্যাবসা ছেড়ে রিকশা চালক, লটারির টিকিট বিক্রেতা, রাজমিস্ত্রি বা খেতমজুর হয়ে গিয়েছেন। যাঁদের হাতে একটু টাকা ছিল, তাঁরা কেউ করেছেন মুদিখানা বা মিষ্টির দোকান, কেউ গাড়ি খাটাচ্ছেন ভাড়ায়। |
এক সময়ে নবদ্বীপের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল হস্তচালিত তাঁত। নবদ্বীপ ব্লকের তাঁত উৎপাদকদের সংগঠন “মহাপ্রভু হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম মালিক সমিতি”-র সম্পাদক মনীন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ বলেন, “আটের দশক পর্যন্ত নবদ্বীপ ব্লকের প্রধান তাঁত উৎপাদক অঞ্চল স্বরূপগঞ্জে ১২ হাজার হস্তচালিত তাঁত ছিল। পঞ্চাশ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে তাঁতের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন সেখানে মেরেকেটে ৭৫০ তাঁত আছে।” মণীন্দ্রবাবুর নিজেরই ১২৮ খানা তাঁত ছিল, কমতে কমতে এখন আর আটখানি তাঁত অবশিষ্ট রয়েছে। কেন তাঁতশিল্পের এই পতন, তা-ও ব্যাখ্যা করেন তিনি (বক্স দেখুন)।
তিন পুরুষ ধরে তাঁতের সঙ্গে যুক্ত বিভাস রায় বলেন, “নবদ্বীপ শহরের চারপাশে অন্তত দু’হাজার তাঁত ছিল, আজ তার অধিকাংশই খুঁজে পাবেন না। সে যুগে সচ্ছলতা মাপা হত তাঁতের সংখ্যা দিয়ে। কার ক’টা তাঁত রয়েছে, তা-ই ছিল সামাজিক প্রতিপত্তির প্রধান মাপকাঠি।” তিন দশক পরে সেই সব পরিবারের সন্তানরা কাজের খোঁজে যাচ্ছেন ভিনরাজ্যে।
একটি পরিসংখ্যান দিয়ে বিভাসবাবু বলেন, “আমাদের নিজেদের তাঁতের সুতো রঙ করার ডাইং ছিল। আটের দশকে প্রতি মাসে ৭০ থেকে ৮০ বেল সুতো রঙ হত। এক বেল মানে দুই কুইন্ট্যাল সুতো। রাত জেগে কাজ হত। এমন ডাইং ছিল ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি। এখন বড়জোর ১৫টি ডাইং আছে।” তাঁতের অনুসারী শিল্প ছিল আরও ১০-১২ রকম। সে সব ব্যবসাও শেষ হয়ে গিয়েছে।
মণীন্দ্রবাবু, বিভাসবাবুদের মত তাঁতশিল্পীদের বিক্রি-করা তাঁতই কখনও সরাসরি, কখনও হাত ঘুরে পৌঁছে যায় কাঠের মিস্ত্রিদের কাছে। কেমন দামে বিকোয় পুরানো তাঁত? নবদ্বীপ পোড়াঘাটের ভাঙ্গাচোরা জিনিসের ব্যবসায়ী মদন রজক বলেন, “খুব বেশি হলে ৩৫০০ টাকা দাম হয় একটা পুরানো তাঁতের। আমরা চালু কথায় একে বলি জাপানি তাঁত। গত কয়েক বছরে তাঁতিরা দলে দলে এই তাঁত বিক্রি করে দিয়েছেন আমাদের কাছে। কাঠ মিস্ত্রিদের কাছেও সরাসরি বিক্রি করেন অনেকে।”
কাঠ ব্যবসায়ী সুব্রত দত্ত, তপন দত্ত বলেন, “তাঁতের কাঠ থেকে খাটের কাঠামো, আলমারির কাঠামো তৈরি করা হয়।” জাপানি তাঁতে প্রধানত লোহা কাঠ ব্যবহার হত, বিকল্পে শাল। সেই লোহা কাঠ এত পোক্ত যে খাট বা আলমারি বানালে তা তিন পুরুষেও কিছু হবে না। বন্যা প্রধান নদিয়াতে তাই তাঁত কাঠে তৈরি খাটের খুব চাহিদা। তবে লোহা কাঠের সেই তাঁতও আর খুব বেশি নেই এই অঞ্চলে।”
আর তাঁতিরা কী বলছেন? নিজের সাইকেলে উঠতে উঠতে নিজের মনেই বিড়বিড় করেন মধ্য-চল্লিশের বিভাস রায়, “তাঁতের কাঠ এখন খাট ছাড়া আর কোন কাজেই বা লাগবে? এ আমাদের অন্তর্জলী যাত্রার খাট।”
কেন ধ্বংসের পথে বাংলার তাঁত:
১। নয়ের দশকে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন বস্ত্র নীতি। আর আগে মিলে মোটা সুতোর রঙিন কাপড় বোনার অনুমতি ছিল না। যন্ত্রচালিত তাঁতে কেবল সাদা থান বোনা যেত। নয়ের দশকে মিলে রঙিন কাপড় বোনার অনুমতি পেলেন মিল মালিকেরা। মিলের উৎপাদিত কাপড়ের দামের সঙ্গে হাতে-বোনা তাঁতের কাপড়ের দাম ও মানের পার্থক্য ঘটে গেল বিস্তর।
২। প্রায় একই সময়ে বাজারে চলে আসে বম্বে মিলের প্রিন্টেড শাড়ি। তাঁতে বোনা ৬০ বা ৪০ কাউন্টের সুতোর মোটা কাপড়ের থেকে কম দামে ছাপা শাড়ি এসে তাঁতের কাপড়ের বাজার নষ্ট করে দেয়।
৩। সুতো, রঙ, মজুরি প্রভৃতির দাম বেড়ে যাওয়ায় বম্বে মিলের ছাপা কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে তাঁতের শাড়ি। |