ডিআইজি কিংবা আইজি পদমর্যাদার কোনও অফিসারকে নয়। পাড়ুই হত্যা-মামলায় খোদ রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি)-কে মূল তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করল কলকাতা হাইকোর্ট। ঘটনার মূল তদন্তকারী কে হবেন, সে ব্যাপারে সরকারপক্ষ এবং আবেদনকারী দু’পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছতে না-পারায় শুক্রবার বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত একতরফা ভাবেই রাজ্য পুলিশের ডিজি গোটুর মহারেড্ডি প্রভু রাজশেখর (জিএমপি) রেড্ডির নাম ঘোষণা করে দিয়েছেন।
বিচারপতি তাঁর নির্দেশে বলেছেন, বীরভূমের পাড়ুই গ্রামে সংগঠিত সাগর ঘোষ খুনের তদন্ত করবে ডিজি-র নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বিশেষ দল, হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে। তদন্তের বিষয়ে ডিজি যে কোনও ভাবে রাজ্য সরকারের কাছে কোনও মতামত চাইতে পারবেন না, এবং রাজ্য প্রশাসনও যে কোনও ভাবে তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, তা-ও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে হাইকোর্ট। বিশেষ তদন্ত-দলের অন্য চার সদস্য যাঁরা হবেন, এ দিন বিকেলের মধ্যে তাঁদের নাম এজলাসে জমা দিতে সরকারপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি দত্ত। |
নিহত সাগর ঘোষের বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে ও বৌমা। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি। |
বিকেলে রাজ্যের তরফে সেই তালিকা সরকারপক্ষের কৌঁসুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাড়ুই-তদন্তের নথিপত্রও এ দিন বিশেষ তদন্তকারীদের হাতে চলে এসেছে। ডিজি’র কাছ থেকে তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্টটি ১৫ দিনের মধ্যে চেয়েছে হাইকোর্ট।
সিআইডি তদন্ত চালানো সত্ত্বেও ডিজি’কে মাথায় রেখে এখন বিশেষ ‘টিম’ গঠনের দরকার পড়ল কেন?
তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন বিচারপতি দত্ত। নির্দেশে তিনি বলেছেন, “গোড়া থেকে তদন্ত যে পথে এগিয়েছে, তা সন্তোষজনক নয়। এক জন ব্যক্তি যতই প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান হোন না কেন, আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। সাধারণ মানুষকে এই আশ্বাস জোগাতে এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি নিহতের পরিবারের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এর প্রয়োজন ছিল।” বিচারপতির মন্তব্য, “রাজনৈতিক হানাহানি-ই হত্যাকাণ্ডটির মূল কারণ। আমার মনে হয়েছে, যে দুই অফিসার এত দিন তদন্ত পরিচালনা করেছেন, তাঁরা চাপের মুখে পড়ে ঘটনার ‘মূল খেলোয়াড়দের’ ধরতে পারেননি। যদিও বহু দিন পরে, অতি সম্প্রতি পাঁচ অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, সাগরবাবুর পুত্রবধূ শিবানী ঘোষ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যে বয়ান দিয়েছিলেন, তাতে অভিযুক্ত হিসেবে প্রথম দু’টি নাম হল তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর। এফআইআরে নাম থাকা ‘প্রথম দুই ভদ্রলোক’ হিসেবে যাঁদের অভিহিত করে গত সোমবার বিচারপতি দত্ত সিআইডি-র কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ওঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? ‘চাপের’ মুখে পড়েই সিআইডি ওঁদের ধরেনি বলে তখন মন্তব্য করেছিলেন বিচারপতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাড়ুইয়ের তদন্তভার আদালত ন্যস্ত করতে চেয়েছিল সিআইডি’র ডিআইজি দময়ন্তী সেনের হাতে। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে দময়ন্তী পাড়ুই-তদন্তের দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করায় অন্য তদন্তকারীর খোঁজ পড়ে। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল কমিশনার (২) সৌমেন মিত্র, আইজি সিআইডি নীরজ সিংহের মতো কিছু নাম উঠলেও বৃহস্পতিবারের শুনানিতে কোনও নাম নিয়েই মামলার তিন পক্ষ একমত হতে পারেনি।
ফলে এ দিনের একতরফা নির্দেশ। তাতে বলা হয়েছে, সিআইডি’র যে সব অফিসার এত দিন পাড়ুই-তদন্তে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নতুন দলে রাখা চলবে না। নতুন টিমের অফিসারেরা কেমন হবেন, নির্দেশে তা-ও স্পষ্ট। ওঁদের হতে বলিষ্ঠ, সাহসী, কোনও চাপের মুখে যাঁরা মাথা নোয়াবেন না। উপরন্তু ডিজি’র প্রতি আদালতের হুঁশিয়ারি: তদন্তের গতি-প্রকৃতি কোনও রাজনৈতিক দলকে অসন্তুষ্ট করলেও তদন্তে যেন তার প্রভাব না-পড়ে। “আশা করি, এই তদন্তে ডিজি তাঁর তরফে সব রকম চেষ্টা চালাবেন, যাতে পুলিশের নষ্ট ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা যায়।” মন্তব্য করেছেন বিচারপতি। |
আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, পাড়ুই-কাণ্ডের এফআইআরে নাম থাকা প্রথম দুই ব্যক্তিকে যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেই গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, মহামান্য আদালতের মন্তব্যে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কার্যত পুলিশ প্রশাসনকেই এ বার চাপে ফেলে দেওয়া হল বলে এই মহলের ধারণা। পাশাপাশি আশার আলো দেখছে নিহতের পরিবার। সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের কথায়, “ডিজি-র মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের অফিসারকে তদন্তভার দেওয়ায় ভরসা পাচ্ছি। বিচারপতি যে ভাষায় তদন্তে সরকারের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করেছেন, তাতে প্রকৃত অপরাধীদের সাজা পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।” পুত্রবধূ শিবানীদেবীর প্রতিক্রিয়া, “বিচারপতির সঙ্গে আমরা একমত যে, তদন্ত প্রভাবিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছে, এ বার সেটা হবে না।”
গত ২১ জুলাই, অর্থাৎ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণের আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুইয়ের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগর ঘোষ। তাঁর ছেলে হৃদয়বাবু নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূর অভিযোগ ছিল, শ্বশুরমশাইকে গুরুতর জখম অবস্থায় ফেলে রেখে পুলিশ তাঁদের দিয়ে জবরদস্তি সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়। পরে তাতে ক’জনের নাম লিখিয়ে সেই সব ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়, আড়ালে থাকে আসল অপরাধীরা। শিবানীদেবী রেজিস্ট্রি ডাকে তাঁর অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন, যেটিকে জেলা পুলিশ এফআইআর হিসেবে গণ্যই করেনি। এ দিকে সাগর-হত্যায় অভিযুক্ত হিসেবে ৭২ দিন জেল খেটে এসে সিআইডি-তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন ওই গ্রামেরই নেপালকৃষ্ণ রায়, নবকৃষ্ণ রায় ও মানস রায়। জেলা পুলিশের তদন্তে অসন্তুষ্ট হাইকোর্ট গত ২৩ ডিসেম্বর পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্তভার সিআইডি’র হাতে তুলে দেয়। আদালতের নির্দেশে তখন শিবানীদেবীর অভিযোগপত্রের ভিত্তিতেও তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু সিআইডি তদন্তের রকম-সকমও যে হাইকোর্টকে খুশি করতে পারেনি, প্রায় প্রতিটি শুনানিতে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। |