প্রাচ্যবিদ্যা বিষয়ক গবেষক ওয়েন্ডি ডোনিগার রচিত গ্রন্থ ‘দ্য হিন্দুজ্’-এর চলতি সংস্করণ ভারতীয় বাজার হইতে তুলিয়া লওয়ার সিদ্ধান্ত লইয়াছে বইটির প্রকাশক। বইটির বিরুদ্ধে সাকেত জেলার নিম্ন আদালতে একটি মামলা রুজু হইয়াছিল। মামলাটি উপেক্ষা করা যাইত কিংবা তাহার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদনও করা যাইত। প্রকাশক সে পথে না গিয়া বইটি প্রত্যাহার করিতেছে। প্রত্যাহারের অধিকার অবশ্যই প্রকাশকের আছে। তথাপি সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যজনক। প্রকাশক স্পষ্টতই শঙ্কিত। আর সেই শঙ্কার কোনও ভিত্তি নাই, এমন কথাও বলা শক্ত। অভিযোগকারী সংগঠনটি অনামা হইতে পারে, কিন্তু প্রচুর বারুদ মজুত থাকিলে একটি স্ফুলিঙ্গও বিপজ্জনক। অপছন্দের মতামত সম্বলিত গ্রন্থ নিষিদ্ধ করার দাবিতে হিংসা, দাঙ্গা, বহ্ন্যুৎসবের যে ঐতিহ্য এ দেশে প্রতিষ্ঠিত, তাহাই হয়তো প্রকাশককে বিচলিত করিয়াছে।
ঐতিহ্যটির মূলে রহিয়াছে শত পুষ্প প্রস্ফুটিত হইতে না দেওয়ার অনমনীয় মানসিকতা। প্রকৃতিতে যে বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি রহিয়াছে, মানবসমাজে তাহা নিষিদ্ধ করার প্রবণতা। কখনও প্রতিষ্ঠান, কখনও কোনও গোষ্ঠী, কখনও রাজনৈতিক দল বা উপদল, কখনও বিশেষ ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সংগঠন কিংবা বৃত্তিজীবীর দল এই প্রবণতা লইয়া সামনে আসে। এই ভাবেই সলমন রুশদির ‘সেটানিক ভার্সেস’ কিংবা তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়, শিবজি বিষয়ক জেমস লেন-এর ইতিহাসগ্রন্থ শিবসৈনিকদের তাণ্ডবে পুড়িতে দেওয়া হয়, মকবুল ফিদা হুসেন অঙ্কিত চিত্রমালায় সজ্জিত স্টুডিয়ো লণ্ডভণ্ড করা হয়, পাক গজল গায়ক গুলাম আলির জলসা বাতিল করিতে হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ডোনিগার লিখিত বইটির বৃত্তান্তেও সেই অসহিষ্ণুতার দীর্ঘ ছায়া। অথচ ডোনিগারের গ্রন্থে অন্যান্য অনেক ধর্মের তুলনায় হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনেরই চেষ্টা করা হইয়াছিল। কিন্তু গোঁড়া ধর্মধ্বজীদের কাছে সেই শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলি গ্রহণযোগ্য মনে হয় নাই।
প্রশ্ন হইল, যদি আগাগোড়া বিরূপ সমালোচনাও থাকে, তাহা হইলেই বা কোনও বই, নাটক, সঙ্গীত, চিত্রকলাকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠিবে কেন? সমালোচনার জবাব দিয়া কিংবা পাল্টা সমালোচনা করিয়া প্রতিস্পর্ধী গ্রন্থ, নাটক, সঙ্গীত, চিত্রকলা রচনা করিলেই তো হয়! সংস্কৃতির বহুত্ববাদী বিকাশের পূর্বশর্ত, বস্তুত গণতন্ত্রের বিকাশের পূর্বশর্তও তো সেটাই। কোনও গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, দল বা সরকারের অপছন্দ বলিয়াই কোনও মতামতকে অপ্রকাশের অন্ধকারে ঠেলিয়া দেওয়া কেন? খাজুরাহো-কোনার্ক-এর মন্দির-ভাস্কর্যের যৌনতা, সংস্কৃত রসসাহিত্যের খোলামেলা জীবনবাদ গোঁড়া রক্ষণশীলদের অপছন্দ হইতেই পারে। তাই বলিয়া তাঁহারা সেগুলি ভাঙিয়া ফেলিবেন বা পুড়াইয়া দিবেন? চার্বাকপন্থীদের দর্শন এবং খোদ চার্বাক মতাবলম্বীদের জীবন্ত পুড়াইবার ইতিহাস অবশ্য এ দেশে আছে। কিন্তু সেই কলঙ্কিত ঘটনা আধুনিক ভারতীয় সভ্যতা বা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভিজ্ঞান হইতে পারে না। সারা বিশ্বেই অধুনা যে বহুসংস্কৃতিবাদের চর্চা, বই-নিষেধের স্বৈরাচার তাহার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু ভারতীয় সমাজ সহস্রাব্দ পূর্বের উদার বহুত্ববাদকে আজ সংশয়ের চোখে নিরীক্ষণ করে। ভারতীয় আইনে আজও সমকামের মতো স্বাভাবিক যৌন অভিযোজনকে ‘অপরাধ’ রূপে শনাক্ত করা হয়, যেহেতু বিষমকামের একত্বকে তাহা চ্যালেঞ্জ করে। এ দেশ বহুর সাধনা জলাঞ্জলি দিয়া অদ্বিতীয় একের সাধনায় মগ্ন। |