প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। লোকসভার স্পিকার অপরিসীম লজ্জাহত। বিরোধী দলের প্রবীণ নায়ক শিহরিত। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন নেতা বৃহস্পতিবার সংসদের ঘটনাবলির নিন্দায় ও ধিক্কারে পঞ্চমুখ। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়ের ত্র্যহস্পর্শে যদি পাপের ক্ষালন হইত, তবে ভারতীয় গণতন্ত্র এত ক্ষণে সত্যযুগে প্রত্যাবর্তন করিত। কিন্তু বাস্তবিক, সে দিনের ঘটনা অভূতপূর্ব হইলেও অচিন্ত্যপূর্ব নহে। বছরের পর বছর, অধিবেশন হইতে অধিবেশন ভারতীয় সংসদের অভিজ্ঞতা ক্রমাগত যে অতলে নামিয়া চলিয়াছে, তাহার এই পরিণামকে ‘অকল্পনীয়’ বলিলে কল্পনাশক্তির দৈন্যই প্রমাণিত হয়। কোনও দলই এ যাবৎ এই নিয়মহারা বিশৃঙ্খলা দেখাইতে পিছাইয়া থাকেন নাই। সংসদে সভার ‘ওয়েল’-এ নামিয়া যাওয়া আর লঙ্কাগুঁড়ো নিক্ষেপ করা যে একই বর্গের অন্যায় নয়, এই মর্মে যতই সবিস্তার ব্যাখ্যা হউক না কেন, এই সূক্ষ্মবিচার শেষ পর্যন্ত অর্থহীন। বিপজ্জনক। অনাচার অঙ্কুরেই বিনাশ করিতে হয়, নতুবা বিষবৃক্ষ এমনই চাড়া দিয়া ওঠে।
প্রশ্ন উঠিবে, স্পিকার বা রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারপার্সন কেন অনাচার দমনে আরও কঠোর হন নাই? কেন তাঁহারা বিশৃঙ্খলা এত দূর অবধি বাড়িতে দিলেন? এবং, সেই সূত্রে, কেন তাঁহারা নিয়মিত বিশৃঙ্খলাকে এত প্রশ্রয় দিয়া থাকেন? বিশৃঙ্খলাকারীদের শাস্তিদানের কোনও ঐতিহ্যই যেখানে মজুত নাই, সেখানে সেদিনকার অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বন্দোবস্ত হইবে কোন যুক্তিতে? অথচ বলাই যায় যে, একটি প্রদেশ যখন ভাগ হইতেছে (এবং স্পষ্টতই প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় স্তরে যথেষ্ট আলোচনা ব্যতিরেকেই ভাগ হইতেছে), তখন সেই বিভক্ত প্রদেশের সাংসদদের তবু একটি সঙ্গত আবেগ থাকে উত্তাল হইয়া উঠিবার পিছনে। কিন্তু ইতিপূর্বে বিজেপি, সি পি এম, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, সকল দলই যখন তুচ্ছ ও নগণ্য বিষয়ে সংসদ অচল করিয়া অনাচারের নিদর্শন রাখিতেছিলেন, সংসদ অধিবেশন অচল করিবার দায়ে তাঁহাদের দৈনিক বরাদ্দ ভাতাটুকুও বাতিল করা হইয়াছিল কি? কাজই যেখানে দিনের পর দিন বন্ধ ছিল, তখন তাঁহারা ‘পারিশ্রমিক’ লইতেছিলেন কোন হিসাবে? তিরস্কার হইতে বহিষ্কার অপরাধের গুরুত্ব ভেদে সব শাস্তিই তো সম্ভবপর, আজ অবধি কোন দল কয় জনকে কী শাস্তি দিয়াছে? এইটুকু করিতেও যাঁহারা পরাঙ্মুখ, এখন কোন যুক্তিতে তাঁহারা সমস্বরে রে-রে করিতেছেন?
দুটি বৃহত্তর বিষয় এই প্রসঙ্গে স্বীকার্য। প্রথমত, রাজনৈতিক দলের যে নেতা-নেত্রীরা নিয়মিত বিশৃঙ্খলার প্রদর্শনী করিয়া থাকেন, মাত্রাছাড়া ঔদ্ধত্যে সংসদে কালিমালেপন করেন, তাঁহারা কেহই আকাশ হইতে নামিয়া আসেন নাই, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হইয়া আসিয়াছেন। সুতরাং এই অব্যবস্থার দায় কেবল নেতাদের নয়, জনগণেরও বটে। তাঁহারা যদি বেনিয়মে মোহিত হন, রাস্তার রাজনীতিকেই সাড়ম্বরে সংসদীয় কক্ষে লইয়া যাইতে চান, তাহা হইলে কোনও গণতন্ত্রের সাধ্য নাই সংসদের মর্যাদা অটুট রাখে। মানুষকেই ভাবিতে হইবে, তাঁহারা কেমন ব্যবস্থা চান, কেমন নেতৃত্ব বা প্রতিনিধিত্ব চান। দ্বিতীয়ত, তেলেঙ্গানার মতো একটি অতি সংবেদনশীল বিষয়ে বিল পেশের জন্য এই ভয়ঙ্কর তাড়াহুড়ার একটিই কারণ: কংগ্রেসের প্রাক্-নির্বাচনী দলীয় হিসাবনিকাশ। এত ক্ষুদ্র স্বার্থে যদি এত বড় প্রশ্নের মীমাংসা বাধ্যতামূলক হয়, তবে সেই তন্ত্রের কাছে আর কী-ই বা আশা করা যায়? সীমান্ধ্রের সাংসদদের অভূতপূর্ব সংসদীয় সন্ত্রাসকে ধিক্কার জানাইবার ভাষা নাই, কিন্তু পাশাপাশি ইউ পি এ সরকারের নির্লজ্জ স্বার্থপরতাও ইতিহাসে খোদিত রহিল। ভবিষ্যৎ ভারত এই যুগল অপরিণামদর্শিতার বিষফল ফলিতে দেখিবে। |