শিয়ালদহ শাখায় ট্রেনের দেরি করার অনিয়মটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং পরিচালনার ত্রুটিই এর অন্যতম মূল কারণ বলে রেলকর্তাদের একাংশের অভিমত। তাঁরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, অবিলম্বে পরিচালন ব্যবস্থার উন্নতি না-হলে শিয়ালদহ ডিভিশনে বৃহস্পতিবার রাতের মতো বিশৃঙ্খলা ফের যে-কোনও সময়েই হতে পারে।
রেলের ব্যাপক পরিচালন ব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট অংশকে বৃহস্পতিবার রাতের বিভ্রাটের জন্য চিহ্নিত করেছেন ওই কর্তারা। রেলের পরিভাষায় তার নাম ‘লিঙ্ক ম্যানেজমেন্ট’। নির্দিষ্ট সময়ে নৈহাটি লোকাল না-ছাড়ায় ওই রাতে প্রায় দেড় ঘণ্টার যাত্রী-বিক্ষোভে শিয়ালদহ স্টেশন রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। সেই ঘটনার ময়না-তদন্তের পরে তদন্তকারীরা শুক্রবার জানান, ট্রেনের ‘লিঙ্ক ম্যানেজমেন্ট’ ফেল করার ফলেই ট্রেন ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। আর তার পরিণামেই বাধে হাঙ্গামা।
কী এই লিঙ্ক ম্যানেজমেন্ট?
রেলকর্তাদের কথায়, শিয়ালদহ উত্তরের চারটে শাখা মিলিয়ে সারা দিনে যত লোকাল ট্রেন চলে, সেগুলোকে একত্র করে চালক ও গার্ডদের একটি ‘লিঙ্ক’ (কে কখন কোন ট্রেনের ভার পাবেন, তার সূচি) তৈরি করা হয়। ধরা যাক, কোনও চালক একটি বনগাঁ লোকাল নিয়ে শিয়ালদহে এলেন। তার ১০ মিনিট পরেই তিনি ফের একটি রানাঘাট লোকালের চালক হয়ে ফিরতি পথে যাবেন। এ ভাবেই এক জন চালকের উপরে বিভিন্ন রুটের ট্রেনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা থাকে। এই লিঙ্ক বা সূচি মানতে হলে প্রতিটি ট্রেনের সময় মেনে চলা দরকার। |
কোনও কারণে একটি ট্রেনের দেরি হলেই লিঙ্ক মেনে তার চালক ও গার্ড ঠিক সময়ে পরের ট্রেনটির দায়িত্ব নিতে পারবেন না। বনগাঁ লোকাল যদি কোনও কারণে দেরি করে, বিলম্ব হবে রানাঘাট লোকালেরও। লিঙ্কের অসুবিধা এটাই।
বৃহস্পতিবার রাতে সেই সমস্যাই হয়েছিল নৈহাটি লোকালের ক্ষেত্রে। ঠিক কী ঘটেছিল?
আপ নৈহাটি লোকালের ছাড়ার কথা ছিল রাত ৯টা ২০ মিনিটে। ঠিক ছিল, ওই ট্রেন নিয়ে যাবেন ডাউন কাটোয়া লোকালের চালক ও গার্ড। কিন্তু কাটোয়া লোকাল আসতে দেরি করে। ফলে দাঁড়িয়েই থাকে নৈহাটি লোকাল। ৪০ মিনিট পরেও সেটি না-ছাড়ায় বিক্ষোভ ও ভাঙচুর শুরু হয়। পরিস্থিতি সামলাতে আরপিএফ স্টেশনের গেট আটকে দিয়ে যাত্রীদের পেটাতে থাকায় জনরোষের আগুনে ঘি পড়ে। আরপিএফের সঙ্গে যাত্রীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর। তার জেরে মেন লাইনের বিভিন্ন স্টেশনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিধাননগর, দমদম-সহ বহু স্টেশনে আটকে পড়েন যাত্রীরা। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী রাতেই নির্দেশ দেন, কেন এই অব্যবস্থা, কেনই বা বিক্ষোভ সেই ব্যাপারে জিএম পদমর্যাদার কাউকে দিয়ে তদন্ত করাতে হবে।
কিন্তু অব্যবস্থা কেন? রোজকার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য যে-লিঙ্ক ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা আছে, সেটাই বা ফেল করল কেন?
রেলকর্তাদের বক্তব্য, ইদানীং ট্রেন বেড়ে যাওয়ায় প্রতি রাতেই শিয়ালদহ ডিভিশনে ট্রেন চালাতে গিয়ে গার্ড ও চালকের অভাব দেখা দিচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী লিঙ্কের প্রয়োজনে অতিরিক্ত গার্ড ও চালকদের প্রস্তুত রাখার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন নতুন নিয়োগ না-হওয়ায় এবং ট্রেনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি গার্ড ও চালক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কোনও ডাউন ট্রেন শিয়ালদহে না-ঢোকা পর্যন্ত আটকে থাকা আপ ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না। কারণ, ওই ডাউন ট্রেনের চালক ও গার্ডেরই তো আপ ট্রেনটিকে নিয়ে যাওয়ার কথা। যেমন বৃহস্পতিবার রাতে ঠিক ছিল, আপ নৈহাটি লোকালটিকে নিয়ে যাবেন ডাউন কাটোয়া লোকালের চালক ও গার্ড।
প্রশ্ন উঠেছে, জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্রতিদিন এক বা দু’জন বাড়তি চালক আর গার্ডও কি রাখা যায় না?
রাখা যে হচ্ছে না, তার জন্য পরিচালন ব্যবস্থার গাফিলতিকেই দুষছেন রেলকর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, পরিচালন ব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকলে এই সমস্যা হয় না। প্রাক্তন রেলকর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর বলেন, “লিঙ্ক ম্যানেজমেন্ট এমন হওয়া উচিত, যাতে প্রত্যেক গার্ড ও চালক ট্রেন নিয়ে আসার পরে অন্তত ১৫ মিনিট সময় হাতে পান। তার পরে তাঁরা পরের ট্রেনের দায়িত্ব নেবেন। অর্থাৎ ডাউন ট্রেন পৌঁছতে দেরি হলেও যেন অসুবিধা না-হয়। সূচি সে-ভাবেই তৈরি করা উচিত।” অর্থাৎ কাটোয়া লোকালের চালক-গার্ডের উপরে আপ নৈহাটি লোকালের ভার না-দিয়ে যদি কিছুটা আগে পৌঁছে যাওয়া কোনও ট্রেনের গার্ড ও চালক ওই দায়িত্ব পেতেন, তা হলে এমন বিশৃঙ্খলা না-ও ঘটতে পারত।
রেলকর্তারা আরও জানান, লিঙ্ক ঠিকঠাক রাখতে গেলে ট্রেনের গতিবেগের উপরেও নজর রাখতে হবে। তার জন্য লাইন, সিগন্যাল বা অন্যান্য পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হওয়া চাই। কিন্তু শিয়ালদহ ডিভিশনে রক্ষণাবেক্ষণের কাজেও গাফিলতির অভিযোগ প্রচুর। হামেশাই লাইন ভাঙছে, সিগন্যাল খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাতেও দেরি করছে ট্রেন। এই সব অভিযোগ কমবেশি মেনেও নিয়েছে রেল।
সুরাহা হবে কী ভাবে? রেলকর্তাদের বক্তব্য, ন’কামরার কিছু ট্রেন কমিয়ে অবিলম্বে ১২ কামরার ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা হলে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে যাত্রীদের। তাতে আপাতত চালক ও গার্ড কম লাগবে। পরিস্থিতিও বদলাবে। স্থায়ী সমাধানের জন্য অবশ্য পর্যাপ্ত চালক ও গার্ড নিয়োগ করতেই হবে। |