ভাঙাচোরা, খোয়া-পাথর ওঠা রাস্তা। বাস, অটো দূরস্থান, একটা ভ্যান-রিকশাও নেই! নির্জন রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি চোখে পড়বে না। সন্ধে নেমে গেলে এ তল্লাটে ঢুকতে এখনও বুক কাঁপে কামদুনিবাসী ছাত্রীদের।
মাস আটেক আগে, গত বছরের ৭ জুন পরীক্ষা দিয়ে এই রাস্তা ধরেই বাড়ি ফিরছিলেন সেই কলেজছাত্রী। সুনসান পথ থেকে যাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উঁচু পাঁচিল-ঘেরা পরিত্যক্ত কারখানায়। গণধর্ষিতা মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহ গ্রামবাসী খুঁজে পেয়েছিলেন রাতে, কারখানার পিছনের পাঁচিলের বাইরে।
ঘটনা ঘিরে রাজ্য উত্তাল হয়। তোলপাড় পড়ে রাজনীতিতে। গড়ে ওঠে কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চ, যার সমর্থনে রাস্তায় নামেন বিশিষ্টদের একাংশ। ক্ষোভ প্রশমণে রাজ্য সরকারও আসরে নেমে পড়ে। কামদুনিকে ‘উন্নয়নে’ ভরিয়ে দেওয়ার দেদার প্রতিশ্রুতি আসে সরকারের তরফে। পরে মৃতার পরিবারের হাতে এক লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য তুলে দেয় সরকার। মৃতার বাবাকে চাকরি দেওয়া হয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদে, ভাই চাকরি পান স্মল অ্যান্ড মাইক্রো স্কেল ইন্ড্রাস্ট্রিজ-এ চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে। গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন মৃতার কাকা বিমল ঘোষ। আদালতে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর স্ত্রীকেও চাকরি দেওয়া হয় মৃতার ভাইয়ের দফতরেই।
মেয়েটির পরিজনেরা ক্ষতিপূরণ ও চাকরি পেয়েছেন ঠিকই। তবে ওই পরিবারের বাইরের কামদুনি রয়ে গিয়েছে সেই আগের কামদুনিতেই! |
বৃহস্পতিবার ছিল কামদুনি গণধর্ষণ-মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। রাজ্য সরকার মৃতার যে ভাইকে চাকরি দিয়েছিল, এ দিন তিনিই সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। ‘‘আর সহ্য হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী এক মাস সময় নিয়েছিলেন। আট মাস পেরিয়ে গেল, বিচার চলছেই! সরকারের তরফে যে ক’টা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, একটাও রাখা হয়নি। রাস্তা হয়নি, আলো আসেনি, অটো-বাস চালু হয়নি। পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্পটাও হল না।’’ আক্ষেপ করেছেন তিনি।
এ দিন কামদুনি ঘুরে বাসিন্দাদের অধিকাংশের মুখ থেকে একই অভিযোগ শুনতে হয়েছে। ঘটনার সময় রাস্তার একটি কালভার্ট মেরামত হচ্ছিল। সেটি সারাই হলেও পিচ-ওঠা রাস্তার চেহারা বদলায়নি। খড়িবাড়ি বা বারাসত বিডিও অফিস দু’দিক দিয়েই সাড়ে চার কিলোমিটার কামদুনির রাস্তার বেশিটা অন্ধকারে ডোবা। সেখানে অটো বা ম্যাজিক ট্যাক্সির মতো যানবাহন চালানোর কথা থাকলেও কিছুই চালু হয়নি। দু’পাশে ভেড়ি। মাঝের শুনশান রাস্তা ধরে বিকেলে কামদুনিতে ফিরছিল কয়েকটি স্কুলের মেয়ে। কারও কারও সঙ্গে অভিভাবক। এক ছাত্রীর মন্তব্য, “এ রাস্তা দিয়ে আসতে গা ছমছম করে। বাবা-মা কেউ থাকলে তা-ও একটু ভরসা হয়।”
বস্তুত ওই মর্মান্তিক ঘটনার পরেও সুরক্ষায় আঁধার দশা কাটেনি কামদুনির। সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে বাসিন্দারা স্থায়ী পুলিশফাঁড়ি তৈরির জন্য নিজেরাই জমি দিয়েছিলেন। সে ফাঁড়ি এখনও হয়ে ওঠেনি। গ্রামের স্কুলঘরে আপাতত অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। “এ ছাড়া নিরাপত্তা বলতে রাত ন’টা পর্যন্ত কয়েকটা জায়গায় পুলিশ পিকেট।” জানাচ্ছেন কামদুনিবাসী।
মৃতার বাড়িটি এখন তালাবন্ধ। সরকারি চাকরি পাওয়ার পরে দু’ভাই ও বাবা-মা কামদুনি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। উঠেছেন বহিরা কালীবাড়ি এলাকার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এ দিন দুপুরে আদালতে মামলা শেষ হওয়ার পরে পুলিশের গাড়িতেই কামদুনি গিয়েছিলেন মৃতার ভাই। তালাবন্ধ বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তালাটা ধরে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়াও করলেন। ধীরে ধীরে বললেন, “দিদি মারা যাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমরা তো শুধু দু’টো জিনিস চেয়েছিলাম। দিদির খুনিদের শাস্তি, আর এখানকার লোকজনের নিরাপত্তা। কিছুই পেলাম না!” তিনি জানান, বুধবার রাতে মা- বাবাকে আরজিকরে ভর্তি করা হয়েছে। বাবার চোখে ফের অপারেশন করতে হবে। আলসারও ধরা পড়েছে। ‘‘মার অবস্থা তো আরও খারাপ। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় ব্লাড প্রেসার বেড়েছে।” বলেন মৃতা ছাত্রীর ভাই।
অভিযোগ কামদুনির সর্বত্র। এমনকী স্থানীয় যে তিনটি ক্লাবকে সরকারের তরফে ১ লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছিল, এখন তারাও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। কী রকম? খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের উপস্থিতিতে গত ৭ জানুয়ারি ক্লাবকে তিনটিকে নিজের দফতর থেকে চেক দেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। একটি ক্লাবের সম্পাদক ক্ষুদিরাম ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘চেকটায় নভেম্বরের তারিখ ছিল। হাতে পাওয়ার এক দিন পরেই সেটা ব্যাঙ্কে ফেলতে যাই। কিন্তু ব্যাঙ্ক জানায়, চেকের তিন মাসের সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে।’’
শেষমেশ ক্রীড়ামন্ত্রীর অফিসে চেকগুলো ফেরত দিয়ে এসেছেন তিন ক্লাবের কর্তারাই। শুধু তা-ই নয়, এ দিন গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন, কামদুনি মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সরকারর তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, স্থানীয় খেলোয়াড়দের কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তালিম দেওয়া হবে। সে সব কিছুই হয়নি। উল্টে বড় ক্লাবে সুযোগ পাওয়ার তাগিদে টুর্নামেন্টে ‘জান লড়িয়ে’ খেলতে গিয়ে স্থানীয় ফুটবলার শানু ঘোষের পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছে। শানুর নিজের কথায়, ‘‘এখনও ঠিক করে হাঁটতে পারছি না। লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেল! সরকারের কেউ খোঁজও নেননি।’’ কামদুনি প্রতিবাদ মঞ্চের নেত্রী মৌসুমী কয়াল বলেন, “সবাই সব কিছু দেখছেন, বুঝছেন। আমরা প্রতিবাদ চালিয়ে যাব। পিছু হটব না।”
মন্ত্রীদের কী বক্তব্য?
রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয়বাবুর দাবি, “কামদুনির সব পরিবারকে অন্ত্যোদয় কার্ড দেওয়া হয়েছে। অটো, ম্যাজিক ট্যাক্সি চালানোর টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। সব কাজ হবে। এ সব প্রক্রিয়া করতে যতটুকু সময় লাগে, সেটুকু না-দিয়ে শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না!” আর চেক-বিভ্রাট প্রসঙ্গে ক্রীড়ামন্ত্রী মদনবাবুর ব্যাখ্যা, “চেকগুলো কাটার পরে ওঁদের হাতে পৌঁছতে দেরি হয়েছে। তবে ওঁরা টাকা পেয়ে যাবেন। নতুন চেক তৈরি হচ্ছে।” |