চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এ এক অন্যরকম অনুভূতি। সারা বছরে এমনটা ঘটে মাত্র দু’একবার। কিন্তু তার রেশ থেকে যায় বছরভর।
সম্প্রতি একটা দিন ছিল এ রকমই। কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির পিছনে বিশাল বড় আমবাগানে তখন চড়ুইভাতির ব্যস্ততা তুঙ্গে। দূর থেকে ভেসে আসছে মাংস কষার গন্ধ। সাউন্ড বক্সে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। মিউজিক্যাল চেয়ার, হাঁড়িভাঙা, জলভর্তি বালতিতে বল ছোড়ার মতো প্রতিযোগিতা ঘিরে একেবারে হইহই কাণ্ড। কাজল মেহতা, মৌসুমি কুণ্ডুর মতো আরও জনা কুড়ি মহিলারা এভাবেই এ দিন হাসি, গান, গল্প, খেলায় মেতে উঠলেন।
ওঁরা সকলেই বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের আবাসিক। জনা কুড়ি ওই আবাসিকদের নিয়ে এদিন চড়ুইভাতির আয়োজন করেছিল বেসরকারি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।” |
বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের সুপার পবিত্রচন্দ্র সরকার বলেন, “ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি মানসিক হাসপাতালের রোগীদের মানসিক পুনর্বাসনও খুব প্রয়োজন। বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের মহিলা রোগীদের জন্য সেই কাজটি করছে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
গত আট বছর ধরে মহিলা আবাসিকদের সেলাই, ছবি আঁকা, নাচগান শেখানোর দায়িত্ব সামলাচ্ছে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। পবিত্রবাবু বলেন, “তুলনামূলকভাবে কিছুটা সুস্থ রোগীদের নিয়ে গিয়ে দুর্গাপুজোর সময় প্রতিমা দর্শন কিংবা শীতকালে চড়ুইভাতির আয়োজন করেন ওই সংস্থার সদস্যরা। দেওয়াল ঘেরা হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আবাসিকরা মুক্তির স্বাদ পান। মন ভাল হয়ে যায়।”
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে রত্নাবলি রায় বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকার ফলে ওই রোগীদের সামাজিক দক্ষতায় মরচে পড়ে যায়। তাঁদের যদি বাইরের আলো বাতাসে নিয়ে যাওয়া যায়, আনন্দ ভাগ করে নিতে শেখানো যায় তবে সামাজিক দক্ষতাগুলো পুনরুদ্ধার হতে পারে। সেই কারণেই তাঁদের নিয়ে চড়ুইভাতি কিংবা শারদোত্সবে প্রতিমা দর্শনের মতো কর্মসূচি নেওয়া হয়।”
কাশিমবাজার রাজবাড়ির আমবাগানে এ দিনের চড়ুইভাতির মেনুতে খাসির মাংস ছাড়াও ছিল ভাত, আলুকপির ডালনা, বেগুনি, মটরশুঁটি দিয়ে মুগ ডাল, আমের চাটনি, দই ও মিষ্টি।
আবাসিকদের মধ্যে প্রৌঢ়া শর্মিষ্ঠার বাড়ি বর্ধমান জেলায়। হিন্দিভাষী কাজল মেহতা ওরফে পার্বতীদেবীর বাড়ি বিহারের সীতামারি জেলার বিশালপুরে। মৌসুমি কুণ্ডুর বাড়ি কল্যাণী। অলোকা সাহা বছর ছয়েক আগে নবদ্বীপ থেকে এসেছেন বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে।
আঠারো থেকে ষাট, নানা বয়সী ওই আবাসিকরা এখন অনেকটাই সুস্থ বলে জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে এ দিনের চড়ুইভাতিতে দিনভর হুল্লোড়ের মধ্যেও হঠাত্ করে চুপ করে গিয়েছেন কেউ কেউ। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলেছেন, “কতদিন ওরা আমাকে দেখতে আসেনি। বাড়িতে একবার খবর দেবেন? জানেন, আমার অসুখ অনেক সেরে গিয়েছে।”
শীতের মিঠে রোদ্দুর সরে যায়। মনখারাপ করা বিকেল নামে। এ বার ফেরার পালা। সাউন্ড বক্সে তখনও বেজে চলেছে-- ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়...’। |