|
|
|
|
কাজ করেও টাকা মিলছে না পশ্চিমে |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
দুর্গাপুজোর আগে থেকে কাজ করছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ দিন কাজ করেছেন। কিন্তু টাকা মিলেছে ৭ দিনের। বাকি টাকা চাইতে গেলেই শুনতে হচ্ছে, ‘আর একটু অপেক্ষা করুন, টাকা এলেই দিয়ে দেওয়া হবে।’ অপেক্ষা করতে-করতে ৫ মাস গড়িয়ে গেল। একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করা সাঁকরাইল ব্লকের রোহিনী গ্রাম পঞ্চায়েতের বাঁকটিয়া গ্রামের গৌর মাহাতোর কথায়, “আমি না হয় থামলাম। বুঝতে পারছি টাকা নেই। কিন্তু কাজ করেছি তো পেট ভরে দু’বেলা খেতে পাব বলে। এতদিন পরেও টাকা না পেলে কাজ করে কী লাভ।”
গৌর মাহাতোর মতো একই সমস্যায় শিরপুরের অদয় নায়েক, ডাহি গ্রামের রমেশ মাহাতোরা। তাঁদের কথায়, “রাস্তা তৈরি ও পুকুর কাটা মিলিয়ে প্রায় ৩০ দিনেরও বেশি কাজ করেছি। কিন্তু দু’তিন মাস হতে চলল এক দিনেরও টাকা মেলেনি। পঞ্চায়েত বলছে, কিছু দিন অপেক্ষা কর, টাকা এলেই দিয়ে দেব। কিন্তু দোকানদারেরা কী ধারে জিনিসপত্র দেবে?” অসহায় রোহিনী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শশাঙ্ক খাটুয়ার কথায়, “৩-৪ মাসে ৮৬ লক্ষ টাকার কাজ করেছি। এখনও কাজ চলছে। কিন্তু পেয়েছি মাত্র ১২ লক্ষ টাকা! তাই তো টাকা দিতে পারিনি।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সর্বত্রই একশো দিনের প্রকল্পের হাল এমন। এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পে জেলা ২৬৪ কোটি ৮ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা পেয়েছিল। ‘এমআইএস এন্ট্রি’ অনুযায়ী ২৪৮ কোটি ৪০ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হাতে রয়েছে, ১৫ কোটি ৬৮ লক্ষ ৫ হাজার টাকা। আর কাজ করিয়ে টাকা দিতে না পারার পরিমাণ, ১০০ কোটি ৬০ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা! ‘এন্ট্রি’ না হওয়া ধরলে টাকা না দিতে পারার পরিমাণ আরও অনেকটাই বেশি। |
সঙ্কটে একশো দিনের কাজের প্রকল্প |
|
ব্লক |
মজুরি বকেয়া |
কেশপুর |
৬ কোটি ৮৫ লক্ষ |
সবং |
৬ কোটি ৬৯ লক্ষ |
দাঁতন-১ |
৬ কোটি ২৫ লক্ষ |
গড়বেতা-২ |
৫ কোটি ৮ লক্ষ |
মেদিনীপুর সদর |
৪ কোটি ৯১ লক্ষ |
ঘাটাল |
৪ কোটি ৮৯ লক্ষ |
নারায়ণগড় |
৪ কোটি ৭৯ লক্ষ |
নয়াগ্রাম |
৪ কোটি ৩৮ লক্ষ |
দাসপুর-১ |
৪ কোটি ২৫ লক্ষ |
গড়বেতা-১ |
৪ কোটি ৫ লক্ষ |
|
এই ব্যাপারে জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, “আমরা তো বারবার টাকা চেয়েছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার টাকা না দেওয়ায় রাজ্যও আমাদের দিতে পারছে না। ফলে সমস্যা তো হচ্ছেই।” জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি বলেন, “এটা আইন। কাজ তো দিতেই হবে। যাতে টাকাও দেওয়া যায়, সে জন্য টাকা চাওয়া হয়েছে।”
অন্য বছরের তুলনায় একশো দিনের প্রকল্পে রাজ্যের ১৩টি জেলা পিছিয়ে ছিল। যার মধ্যে ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরও। গত আর্থিক বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা যেখানে ১ কোটি ৬৫ লক্ষ ৯০ হাজার ৪৪১টি শ্রম দিবস তৈরি করতে পেরেছিল, সেখানে চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রমদিবস তৈরি হয়েছিল মাত্র ৪৪ লক্ষ ৫৭ হাজার ৭৩৬ দিন। অর্থাত্ তিন গুণেরও কম। সব দেখে রাজ্য প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। ওই মাসেই কাজের গতি কম এমন জেলাগুলিতে রাজ্যের পদস্থ আধিকারিকেরা গিয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারপরই তড়িঘড়ি কাজে নেমে পড়ে সকলে।
১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, তাতেই টান পড়েছে টাকায়। জেলাতে কাজ করিয়ে টাকা না দিতে পারার পরিমাণ প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। এখনও বিভিন্ন কাজ চলছে। দীর্ঘ দিন এ ভাবে কাজ করিয়ে টাকা না দিতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে বিক্ষোভ-অশান্তির আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া আইনেও বলা রয়েছে কাজ করিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা দিতেই হবে।
যদিও ১৫ দিনের মধ্যে কখনওইটাকা দিতে পারে না বলে একশো দিনের প্রকল্পের একটা বদনাম আছে। সাধারণ ভাবে এক জনকে এক টানা ১৪ দিন কাজ দেওয়ার নিয়ম। ১৪ দিন কাজ দেওয়ার পর মাস্টার রোল নিয়ে এসে এন্ট্রি করাতে ন্যূনতম ২০ দিন সময় লাগে। তারপর টাকা দেওয়া হয়। অর্থাত্ প্রতি ক্ষেত্রেই এক মাসের আগে কেউ টাকা পান না। আর এই কারণেই অনেক সময়ে একশো দিনের প্রকল্পে কাজের লোকও মেলে না। প্রতিদিনের খরচ চালাতে অনেকেই কম টাকায় অন্যের বাড়িতে কাজ করতে চলে যায় শুধু নগদ টাকা পাওয়ার লোভে। আর এখন তো যা পরিস্থিতি, তাতে পাঁচ-ছ মাসেও মজুরি মিলছে না।
এই পরিস্থিতিতে কিছুটা ধীরে চলো নীতি নিয়েছে প্রশাসন। পদস্থ এক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, “এক সময় কাজ হচ্ছিল না। জেলা পিছিয়ে পড়ছিল। তা নিয়ে কত সমালোচনা শুনতে হয়েছে। এবার সকলকে কাজে নামানো গিয়েছিল। গতিও এসেছিল। এমন সময় আবার টাকা নেই। সামনেই নির্বাচন। তাতে কাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে এই প্রকল্পে চলতি আর্থিক বছরে আর ততটা এগোনো সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার ২৯টি ব্লকের মধ্যে কেশিয়াড়িতে ৫৬ লক্ষ টাকা দেওয়া যায়নি, আর খড়্গপুর-১ ব্লকে ৯৬ লক্ষ টাকা দেওয়া যায়নি। টাকা না দিতে পারার তালিকায় সবার উপরে রয়েছে কেশপুর। যেখানে কাজ করিয়েও ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা দেওয়া যায়নি। |
|
|
|
|
|