আপ নৈহাটি লোকালের ছাড়ার কথা ছিল রাত ৯টা ২০ মিনিটে। কিন্তু তার ৪০ মিনিট পরেও সেটি না-ছাড়ায় বৃহস্পতিবার রাতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে শিয়ালদহ স্টেশনে। যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে নেমে বিক্ষোভ দেখান। ভাঙচুর করা হয় একাধিক লোকাল ট্রেন। লাঠি উঁচিয়ে বিক্ষোভকারীদের তাড়া করে পুলিশ। তাদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায় যাত্রীদের। স্টেশনের গেট আটকে আরপিএফ জনতাকে লাঠিপেটা করে বলে অভিযোগ। লাঠির ঘায়ে বেশ কয়েক জন যাত্রী আহত হন।
যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যে জোর দেওয়া হয়েছে এ বারের রেল বাজেটে। সেই বাজেট-আশ্বাসের পরের রাতেই চালক ও গার্ডের অভাবে এই ট্রেন-বিভ্রাট। ট্রেন ছাড়তে দেরি কেন, কখন তা ছাড়বে সেই বিষয়ে ঘোষণা তো ছিলই না। স্টেশনে যখন ধুন্ধুমার চলছে, রেলের কোনও পদস্থ অফিসারকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। যাত্রী পরিষেবায় রেলের সদিচ্ছা নিয়ে তাই ফের প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
রাতেই তদন্তের নির্দেশ দেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। তাঁর নির্দেশ, কেন ট্রেন ছাড়তে দেরি হল, কেন যাত্রীরা বিক্ষোভ দেখালেন জিএম পদমর্যাদার কাউকে দিয়ে তার তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে হবে। আজ, শুক্রবার বহরমপুরে রেলের ‘ঐতিহ্য মেলা’র উদ্বোধন করবেন অধীরবাবু। সেই মেলায় যাওয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পদস্থ রেল অফিসারদের নিয়ে রাত সাড়ে ১০টায় শিয়ালদহ থেকে বিশেষ ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। যাত্রী-বিক্ষোভে সেই ট্রেনও আটকে যায়। আটকে পড়েন রেলকর্তারাও। কিন্তু বিক্ষোভ সামলানোর জন্য তাঁদের কাউকে আসরে নামতে দেখা যায়নি।
শিয়ালদহে এখন দেরিতে ট্রেন ছাড়ার অনিয়মটাই নিয়ম। এ দিনও সেটাই হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট দশেক আগে থেকেই দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে নৈহাটি লোকালে উঠে অপেক্ষা করছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু চালক ও গার্ডের দেখা নেই। ৪০ মিনিট পরেও ট্রেন না-ছাড়ায় যাত্রীদের একাংশ গার্ডের কামরার সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। প্ল্যাটফর্মের কল থেকে বোতলে জল ভরে ছোড়া হয় গার্ডের কামরায়। ইট দিয়ে ট্রেনের হেডলাইট ভাঙার চেষ্টা চলে। বেগতিক দেখে গার্ড তাঁর কামরার দরজা-জানলা বন্ধ করে দেন। ক্ষিপ্ত যাত্রীরা লাথি-ঘুষি মারতে থাকেন গার্ডের কামরায়। |
ভাঙচুর চলছে শিয়ালদহে। বৃহস্পতিবার রাতে। ছবি: সুমন বল্লভ। |
চালক ও গার্ডের অভাবে পাশের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে গেদে লোকালও আটকে পড়ে। সেটির ছাড়ার কথা ছিল সাড়ে ৯টায়। ১০টার পরে নৈহাটি লোকালের যাত্রীরা যখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তখনই গেদে লোকাল ছাড়ার কথা ঘোষণা করা হয়। যাত্রীদের ক্ষোভ বেড়ে যায়। তাঁরা গেদে লোকালও আটকে দেন। সেটিরও গার্ডের কামরায় হামলা হয়। ছোড়া হতে থাকে জল ভরা বোতল।
পুলিশ আসার পরে শুরু হয় বাগ্বিতণ্ডা। যাত্রীদের একাংশ মারমুখী হয়ে ওঠেন। লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে পুলিশ। পুলিশের লাঠির ঘায়ে আহত হন কয়েক জন যাত্রী। জনরোষ বেড়ে যায়। গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ে তিন-চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে। সেখান থেকে অন্য দু’টি লোকাল ট্রেনের ছাড়ার কথা ছিল। সেগুলোও আটকে পড়ে। বিধাননগর ও দমদমে যাঁরা ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন, ধৈর্য হারিয়ে তাঁরাও সেখানে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বিধাননগরে দু’টি ডাউন ট্রেনের চালকেরা বিক্ষুব্ধদের হাতে আক্রান্ত হন বলে রেলের অভিযোগ। সেখানে রেললাইনে বিক্ষোভের ফলে দার্জিলিং মেলের মতো দূরপাল্লার কিছু ট্রেনও আটকে পড়ে। দমদম-সহ বিভিন্ন স্টেশনে ঘরমুখী যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ট্রেনের আশা ছেড়ে অনেকে অটো-বাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে দু’টি ডাউন ট্রেন আটকে পড়ে।
শিয়ালদহে বিক্ষোভ বাড়তে থাকায় আরপিএফ আসে। তারা মেন স্টেশনের সব গেট বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের পেটাতে থাকে বলে অভিযোগ। আহত হন বেশ কয়েক জন যাত্রী। রক্তাক্ত যাত্রীদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে। প্ল্যাটফর্মে চোখে পড়েছে রক্তের দাগ। পরে ফের গেট খুলতেই অনেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে থাকেন। রাত ১০টা ৫০ মিনিটে গেদে লোকাল ভাঙা কাচ নিয়েই ছেড়ে যায়। ভাঙচুরে বিধ্বস্ত নৈহাটি লোকাল তখনও দাঁড়িয়ে। হাঙ্গামা থামার পরে, রাত ১১টা ২০ মিনিটে স্টেশনে প্রথম ঘোষণা শোনা যায়!
নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, ইদানীং প্রায় প্রতি রাতেই শিয়ালদহে গার্ড ও চালকের টানাটানি চলছে। কোনও ডাউন লোকাল ট্রেন শিয়ালদহে ঢোকার পরে তার গার্ড ও চালক স্টেশনে আটকে থাকা আপ ট্রেন নিয়ে রওনা হচ্ছেন। বৃহস্পতিবার রাতে আপ নৈহাটি লোকালের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হয়েছে। যে-গার্ড ও চালকের এই ট্রেন নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, ডাউন ট্রেন নিয়ে আসতে তাঁদের দেরি হয়। প্রতিদিন শিয়ালদহে অতিরিক্ত গার্ড ও চালক রাখার কথা। যাতে কোনও লোকাল দেরিতে এলে অতিরিক্ত গার্ড ও চালক আটকে থাকা আপ ট্রেন নিয়ে সময়মতো রওনা হতে পারেন। কিন্তু বাড়তি গার্ড-চালক রাখার নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে কোনও ডাউন ট্রেন শিয়ালদহে না-পৌঁছনো পর্যন্ত আটকে থাকা আপ ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না। |