|
|
|
|
হাসাতে হাসাতে ভাবাবে নাইটি |
আঁতলামি নেই। ভালবাসার দিনে মুক্তি পাওয়া এ যেন বাঙালির ‘cuming’ অব এজ সিনেমা। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
আচ্ছা দর্শক, আপনি কি কবি উৎপলকুমার বসুর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পুরী সিরিজ’য়ের কবিতাগুলো কখনও পড়েছেন? নিদেনপক্ষে বইটার নাম কখনও শুনেছেন? শোনেননি? আপনার অত কাব্যপ্রীতি নেই? তা ছাড়া আপনি বুঝতে পারছেন না, ‘অভিশপ্ত নাইটি’ নামক এই ছবির সমালোচনায় ‘হাঙরি জেনারেশন’য়ের এক কবির নাম কী করে আসে? সে তো পুরো আঁতেল ব্যাপার! আর এখানে তো ছবির পোস্টারে ‘cuming, cuming, cuming’ দেখেই আপনি যা ভাবার ভেবে নিয়েছেন! cuming শব্দটা আর যা হোক বাঙালির পাতে দেওয়ার মতো নয়। যদিও ছেলেপুলেরা ‘coming’ এবং ‘come’-য়ের জায়গায় ‘cuming’ আর ‘cum’ অনায়াসে ব্যবহার করছে। কিন্তু এই তো সে দিন আপনার সেক্রেটারি মেয়েটি ফোনের টেক্সটের বয়ানে ওই রকম একটা ‘cum’ লিখে পাঠানোয় আপনি তো পুরো গুম মেরে গিয়েছিলেন।
তিন দিন মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতে পারেননি! তাই ছবির নাম যেখানে ‘অভিশপ্ত নাইটি’, সেখানে পোস্টারে ওই ‘Cuming’ দেখে আপনি একজন সভ্য শিক্ষিত বাঙালি হিসেবে নিশ্চয়ই ভেবেছেন এই ছবি ‘নট মাই কাপ অব টি।’ এ যাবৎ কালে কম মাত্রায় নাটকীয়, বেশি মাত্রায় ইন্টেলেকচুয়াল মানবমানবীর সম্পর্কের ওপর (পড়ুন এক্সট্রাম্যারিটাল রিলেশন) ছবি দেখাতেই আপনার সিনেমা রুচির যথেষ্ট বাড়বৃদ্ধি ঘটেছে! অতএব এই ছবিটাকে আপনি এক রকম উপেক্ষা করবেনই ভেবেছেন। কিন্তু প্রযোজনায় যেহেতু ‘ শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস’, সেহেতু ঠিক মনস্থির করতে পারছেন না! আপনার এই তথৈবচ অবস্থায় আপনাকে আরও একটা প্রশ্ন করছি। আচ্ছা ‘ভানু ও বনু’ এই কথাটা শুনলে কি আপনার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাণু ও ভানু’ মনে পড়ছে? ‘পুরী সিরিজ’ না পড়লেও তো আপনি এই বইটা নেড়েঘেঁটে দেখেছিলেন। বিশেষ একটা অংশ পড়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘অভিশপ্ত নাইটি’র সঙ্গে ‘রাণু ও ভানু’ পর্দায় কী ভাবে যুক্ত হচ্ছে তা আপনার মাথায় ঢুকছে না! অভিশপ্ত না কি রবীন্দ্রনাথকেও টেনে এনেছে ছবিতে? আজ্ঞে হ্যাঁ! টেনে এনেছে তো বটেই এবং বাঙালির রবীন্দ্রনাথ প্রীতির (পড়ুন মাস হিস্টিরিয়া) একটা নামও দেওয়া হয়েছে ছবিতে ‘এক্সট্রা টেগোর সিন্ড্রোম।’ |
|
এক কালবৈশাখী ঝড়ে দত্তবাড়ির ছাদে কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ে ক্রিমসন কালারের লেসের কাজ করা, সাটিনের একটা দুর্দান্ত নাইটি। গড়িয়াহাটার ফুটপাতে দেড়শো টাকায় কিনতে পাওয়া যায় যে-নাইটি, সে-নাইটি নয় মহাশয়। যে ধরনের নাইটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পাড়ায় মেলা থাকলে পাড়ার ছেলেরা সকাল-বিকেল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শিস দিয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে ঠিক সেই রকম নাইটি একটা। সেই অভিশপ্ত নাইটি শরীরে গলিয়ে দত্তবাড়ির বৌ, দত্তবাড়ির গিন্নি আর কাজের মেয়ে সকলেই কলঙ্কিত হল, মিলনতাড়িত হয়ে কেউ বাড়ির দুধওয়ালার বাহুবন্ধনে ধরা দিল, কেউ নাতির গানের মাস্টারকে শয্যায় টেনে নিল! এইখান থেকে গল্প রোল করতে শুরু করল। সেই গল্পের মূলে আছে ওই সাটিনের নাইটি। এ কথা বলাই বাহুল্য। এবং সেই গল্প যত এগোয়, আপনি একটা দমফাটা হাসির সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়েন। এত নগদ হাসিঠাট্টা শেষ যে যে-ছবিতে দেখেছেন (পড়ুন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’) তার থেকেও বেশি। পরিকল্পিত, হাস্যমুখর। কিন্তু আপনি ছবি দেখবেন, হাসবেন, চলে আসবেন এখানে তা হওয়ার নয়। এ ছবি তার থেকে আপনাকে আরও অনেক গভীর মাত্রায় বিনোদিত করবে, যদি আপনি নিজের চার পাশ সম্পর্কে একজন সচেতন মানুষ হন। কারণ পরিচালক বিরসা দাশগুপ্তের কাহিনি আর চিত্রনাট্য, সংলাপ লিখেছেন দেবালয় ভট্টাচার্য। এঁরা দু’জনে ব্যঙ্গনিপুণ, কৌতুকময় এই ছবির উপাদানে যে ভাবে বাঙালির গত পঞ্চাশ বছরের সামাজিক ইতিহাসকে গেঁথে তুলেছেন, এবং সেই ইতিবৃত্তকে এই সময়ের বহমানতায় এনে ফেলেছেন, সেগুলোকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন আবার পরম মমতায় ধুয়েমুছে তুলে এনে রেখেছেন জামার পকেটে, তাতে মননশীল দর্শকের পক্ষে বিস্ময়ে, আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে থাকাই মুশকিল কিন্তু!
এই সামাজিক ইতিহাস আর এই সামাজিক বিবর্তনের মধ্যে অবিকল্প ভাবে এসে পড়েছে টেগোর সিন্ড্রোম, পুরী সিরিজ, ব্যাঙ্ককে বঙ্গসম্মেলন, বাঙালির পুরির নুলিয়া-রোম্যান্টিকতা, মহমম্দ আজিজের ‘পৃথিবী হারিয়ে গেল মরু সাহারায়’, কুমার শানু, ‘লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ’কে দাঁত চেপে অতিরাবীন্দ্রিক ঘরানায় গাওয়া ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, আরএসজে (ভিলেন) থাকবে কতক্ষণ আরএসজে (ভিলেন) যাবে বিসর্জন, থেকে শুরু করে কয়লা মাফিয়া কাম সিনেমা প্রোডিউসর, রবীন্দ্রনাথকে স্বামী বলে মানা বনলক্ষ্মী হোড়। দেবের চরিত্রে দেব ফাইটিং হিরো, যে বন্দুককে লাইটারের মতো ব্যবহার করে সিগারেট জ্বালায়। আছে পিশাচসিদ্ধ (মিস জোজো)। সম্মোহনের পর এলাকার মস্তানের ‘ব্রিগেড চলো, ব্রিগেড চলো’ বলে ওঠা। হোমোসেক্সুয়াল ফিল্ম ম্যাগাজিন সম্পাদক (কাকে মনে পড়ছে? তিনি আমাদের বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন)। আছে ‘খাবার মধ্যে ভাত/ আর পরার মধ্যে নাইটি’। আছে ‘তোমরা ছেলেরা শোওয়া ছাড়া কিছু বোঝো না’, ‘বুঝি কিন্তু বোঝাতে পারি না’র মতো ডায়ালগ!
একটা ছবির মধ্যে যেখানে যতটা সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনার পুরো সৎ রূপান্তর ঘটেছে ‘অভিশপ্ত নাইটি’তে। সম্ভাবনার একটা পাথরকেও না উল্টিয়ে রাখা হয়নি! যখন আপনি সিনেমা দেখে হাসছেন, তখন আপনি ভিতরে ভিতরে আপ্লুত হয়ে ভাবছেন যে, কী প্রচণ্ড পরিশ্রম করা হয়েছে এ রকম একটা ফ্ল-লেস স্ক্রিনপ্লে তৈরি করতে। এ হেন বুদ্ধিদীপ্ত, চৌখশ, হিউমারাস, জমজমাট ছবি এরা বানাল কী করে! বিরসা ও দেবালয়ের কারুবাসনা আপনার হতোদ্যম বাঙালিত্বকে রূপনারায়ণের কূলে জাগিয়ে তুলছে ওই! আর এই সব কিছুর কেন্দ্রে থাকা সাটিনের নাইটিটাও প্রায় দুষ্মন্ত-শকুন্তলা উপাখ্যানে মাছের পেটে চলে-যাওয়া আংটিটার মতোই! নিজেই একটা চরিত্র, একটা সিম্বল! একটা আত্মা, একটা প্রেত! এ ছবির সুরারোপ করেছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। ক্যামেরায় সৌমিক হালদার। গান লিখেছেন শ্রীজাত, প্রসেন, বোধা। ‘সাধের লাইটি’ বা ‘আজ খুব মেঘ করুক’ দু’টো গানই ছবির আবেদনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। লকেট, লাবণি, ভাস্কর, পরমব্রত, তনুশ্রী, মীর সবাই যে-অভিনয়টা এখানে করে গেলেন, তার জন্য এঁদের সবার একটা স্ট্যান্ডিং ওভেশন প্রাপ্য!
বিরসা-দেবালয়কে ঘিরে আম-দর্শক কিংবা বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবে বোঝাই যায়! এই ছবির মধ্যে নিজেদের নিংড়ে দিয়েছেন বিরসারা। আগামী দিনে এই সাফল্যকে ধরে রাখতে এ ভাবেই জীবনের ওতপ্রোত অলিগলিগুলোর দিকে মমতা মাখা চোখে, দরদ নিয়েই
তাকাতে হবে। যে দরদ-ভালবাসার মধ্যে ওই ‘পিথিবী হারিয়ে গেল মরু সাহারায়’য়ের মতো গানও পরিত্যাজ্য হয় না! |
|
|
|
|
|