দিল্লির সম্মতি মিলেছিল এগারো বছর আগে।
তবে লাল ফিতের ফাঁস খোলেনি। রাজ্যের বন দফতরের টেবিলে ফাইল বন্দি হয়ে এখনও তা ‘বিবেচনাধীন’।
কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন সত্ত্বেও উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের দু’টি হস্তী প্রকল্প গড়তে রাজ্যের এমন ‘নেতিবাচক মনোভাব’ কেন? তা নিয়ে এ বার প্রশ্ন তুলল কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক। বনমন্ত্রকের এক যুগ্ম সচিবের দাবি, “দু’টি প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের বরাদ্দ প্রতি বছর মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু সে টাকা আদৌ ওই দুই প্রকল্প উন্নয়ন খাতে ব্যবহার হয় কিনা তা নিয়েই সংশয় রয়েছে। রাজ্যের কাছে এর জবাব চাওয়া হচ্ছে।”
উত্তরের ইস্টার্ন ডুয়ার্স এবং দক্ষিণবঙ্গের ময়ূরঝর্না হস্তী-প্রকল্প দু’টি গড়তে দিল্লি সম্মতি দিয়েছিল ২০০২ সালে। বাম জমানায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের এলাকা নির্ধারণের জন্য মাপজোক হয়েছিল। তবে ওইটুকুই। কাজ আর এগোয়নি। সরকার বদলের পরে, গত তিন বছরে ছবিটা প্রায় অপরিবর্তিত। সরকারি সূত্রেই জানা গিয়েছে, দু’টি প্রকল্প নিয়ে বনাধিকারিকেরা আলোচনায় বসার ‘সময়’ই পাননি।
কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি এখানেই। বনমন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, প্রতি বছর দুই প্রকল্প খাতে অন্তত ১.৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। খাতায় কলমে সে টাকা প্রস্তাবিত হস্তী প্রকল্পেই ‘ব্যয়’ হয় বলেই রাজ্য সরকারের দাবি। দিল্লির পাল্টা দাবি--হস্তী প্রকল্প দু’টির অস্তিত্ব নিছকই খাতায় কলমে, তাদের সীমানা স্পষ্ট নয়, প্রকল্পের আধিকারিক কে, কেউ জানে না। নেই কোনও নির্দিষ্ট কর্ম-পরিকল্পনাও। ওই কর্তার অভিযোগ, “কার্যত অস্তিত্বহীন দু’টি প্রকল্পের নামে বছরের পর বছর অনুদান নিচ্ছে রাজ্য বন দফতর।” |
কেন? রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন বলছেন, “সদ্য দায়িত্ব নিয়েছি। বনকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রকল্প দু’টি কী অবস্থায় রয়েছে খোঁজ নিতে হবে। তার পরে বলতে পারব।” বন দফতর সূত্রে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, কেন্দ্রীয় বরাদ্দের টাকা যথাযথ খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু যে হস্তী প্রকল্পের সীমানা নির্দেশ এখনও প্রস্তাব আকারে পড়ে, প্রকল্প দু’টির দায়িত্বে নেই কোনও বনাধিকারিক, সেক্ষেত্রে বরাদ্দ টাকা ব্যয় হচ্ছে কী করে?
২০০২ সালের অগস্ট মাসে উত্তরবঙ্গের গরুমারা ও মহানন্দা জাতীয় উদ্যান, জলদাপাড়া অভয়ারণ্য এবং বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৯৭৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তীর্ণ ইস্টার্ন ডুয়ার্স হস্তী-প্রকল্প গড়তে রাজ্য সরকারের কাছে খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। ওই বছরে অক্টোবর মাসে দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার পাঁচটি ডিভিশনের ৪১৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ময়ূরঝর্না হস্তী-প্রকল্প গড়ার সুপারিশ করা হয়। তবে তা খাতায় কলমেই। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজ্যে হস্তী-সমস্যা অনেকটাই সামাল দেওয়া যেত।
রাজ্যের এক পদস্থ বনকর্তা বলেন, “উত্তরবঙ্গের জঙ্গল ফুঁড়ে যাওয়া রেলপথ অনবরত পারাপার করে হাতিরা। দুর্ঘটনা এড়াতে ওই লাইন পারাপারের জন্য বিশেষ এলিফ্যান্ট-ওয়ে গড়া প্রয়োজন। তাদের চলা ফেরা জঙ্গলের সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলে লোকালয়ে তাদের হামলাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হাতির হানায় এ রাজ্যে গড়ে অন্তত ৭৫ জনের মৃত্যু হয়। যার ক্ষতিপূরণের বহরও গুনতে হয় বন দফতরকে। অর্থাভাবে অনেক সময়ে যা দেওয়াই যাচ্ছে না।” তাঁর দাবি, সরাসরি হস্তী প্রকল্পের আওতায় থাকলে এই সব খরচের সিংহ ভাগই বহন করত কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রক। টাকার সংস্থান নিয়ে অন্তত ভাবতে হত না।
হস্তিযূথের উপরে নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় বনকর্মীও নেই। কর্মী নিয়োগ বন্ধ, ট্রেজারি আইনের জটিলতায় অস্থায়ী কর্মী নিয়োগও থমকে রয়েছে। রাজ্যের অধিকাংশ বনাঞ্চলে যে যথাযথ প্রহরা হচ্ছে না, বনকর্তারা তা মেনেও নেন। সেখানে রাজ্যের প্রায় সাড়ে ছ’শো হাতির জন্য আলাদা নজরদারি করবে কে?
১৯৯২ সালে উত্তরবঙ্গের পাঁচটি ডিভিশন মিলিয়ে হাতির সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ১৮৬। ২০১০-এর সুমারিতে দেখা গিয়েছে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২৯। এখন তা আরও বেড়েছে। অন্য দিকে, দক্ষিণবঙ্গের বনাঞ্চলে হাতির সংখ্যা অন্তত ৪০। তার উপর ঝাড়খণ্ডের দলমা পাহাড় থেকে প্রায় শ’দেড়েক হাতির একটি দল বছরের একটা সময় দক্ষিণবঙ্গের তিন জেলা দাপিয়ে বেড়ায়।
টানাটানির কোষাগার এবং সাকুল্য জনা কয়েক বন প্রহরী, তা দিয়ে এই বিপুল হস্তিকুল সামাল দেওয়া সম্ভব?
বন কর্তাদের আক্ষেপ, প্রকল্প দু’টি বাস্তবায়িত হলে সেই ‘অসম্ভব’ই কিন্তু অনেকাংশে সম্ভব হয়ে উঠত। |