|
|
|
|
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ |
খাদে পড়ে শ্যুটিং |
অর্ধেক টালিগঞ্জ সিকিম পাহাড় থেকে গড়িয়ে ন’শো ফুট নীচে।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির আউটডোর শ্যুটিং দেখে এলেন সংযুক্তা বসু। |
ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা!
একটা বাস পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছিল ন’শো ফুট নিচু খাদে। পাহাড়ের খাঁজে ভেঙেচুরে, দুমড়েমুচড়ে আটকে-থাকা বাস থেকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেরিয়ে আসা যাত্রীরা কোনও ক্রমে প্রাণে বেঁচেছিল বটে, কিন্তু আতঙ্কে দিশেহারা। কারও পোশাক রক্তে ভিজে। কারও বা কেটেছড়ে গিয়েছিল মুখ-গা-হাত-পা। রক্ত ঝরতে ঝরতে শুকিয়ে যাচ্ছিল। কেউ বা যন্ত্রণায় কাতর...
আর কোনও গাড়ি পাওয়া যাবে না। সন্ধে পার হয়ে ক্রমশ নেমে আসছে রাত। কাছাকাছি কোনও হোটেল নেই। বসতি নেই। মোবাইলে কোনও যোগাযোগ করার উপায়ও নেই।
আসলে সভ্যতার সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন। যে কোনও মুহূর্তে হানা দিতে পারত চিতার দল। অথবা অন্য কোনও ভয়াল শ্বাপদ। আর ঠিক এই ভাবেই ন’শো ফুট খাদে গড়িয়ে গিয়েছিল আধা টালিগঞ্জ। এবং গড়িয়ে গিয়েও ফিরে এল ওপরে। জীবনের দিকে উঠে এসে বলেছিল লাইট... ক্যামেরা... অ্যাকশন.....
এই ভাবেই শুরু হয়েছিল
শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস প্রযোজিত ‘খাদ’ ছবির শ্যুটিং। ফিরে এসে খবর মিলল এক পক্ষ কাল পেরিয়ে আজ সেই বিশাল আউটডোরের শেষ দিন। |
|
খাদে গড়িয়ে গিয়েও ফিরে এলেন বাসযাত্রীরা। আর তার পর? |
এমনটা সচরাচর হয় না |
খাদের অদূরে পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে গেলে একটা নদী চোখে পড়ে। নদীর পাথুরে তটভূমিতে কোনও ক্রমে যদি একটা রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে পরের দিন সকালে বাস পেলেও পাওয়া যেতে পারে। এই আশায় বুক বেঁধে যাত্রীরা নেমে যায় নদীর পারে। মালপত্র যেটুকু যা অক্ষত আছে তা নিয়ে পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে। তাদের মুখে তখনও মৃত্যুভয়ের চিহ্ন দুলছে।
টুকরো টুকরো আলাপ দিয়ে পরিচয় বিনিময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে। সমস্ত শ্রেণি-বিভাজনের ঊর্ধ্বে রিক্ত, নিঃস্ব গুটিকয়েক চরিত্র। শুধু একটা রাতকে ঘিরে কথায় কথায় প্রত্যেক আহত যাত্রীর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আর একটা মানুষ। তার ভেতর লুকিয়ে থাকা আরও একটা মানুষ। ভাল-মন্দ মিলিয়ে-মিশিয়ে আটপৌরে পরিচয় থেকে আলাদা।
আলাদা। তবু সত্যি! তবু সে-ও এক বাস্তব।
খাদের কিনারে পৌঁছোলে তবেই না জীবন, মৃত্যুর ছ্যাঁকা খেয়ে নিখাদ সোনা হয়ে ওঠে....এই রকমই এক দর্শনকে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় মেলে ধরতে চাইছেন তাঁর ছবিতে। রীতিমতো চমকপ্রদ তারকা সমাবেশ ঘটিয়ে, সকলের কাছে একই সময়ে ডেট নিয়ে, এক লোকেশনে পনেরো দিন টানা তাঁদের ধরে রেখে, এত সুপরিকল্পিত লম্বা আউটডোর শ্যুটিং বাংলা ছবির দুনিয়ায় সাম্প্রতিক কালে সচরাচর হয়নি।
দুঘর্র্টনাগ্রস্ত বাসযাত্রী সবে মিলে টালিগঞ্জের ষোলো জন। লিলি চক্রবর্তী, গার্গী রায় চৌধুরী, পল্লবী চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, তনুশ্রী চক্রবর্তী, মিমি চক্রবর্তী, ত্রিধা চৌধুরী, মাসুদ আখতার, সায়ক বসু, অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য, রাজদীপ ঘোাষ, ভরত কল, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। |
হঠাৎ চিতার আবির্ভাব |
বিকেল পেরিয়ে তখন সন্ধে নেমেছে। দক্ষিণ সিকিমের ছোট শহর জোরথাংয়ের কাছাকাছি রামবাং নদীর স্রোত আছড়ে পড়ছে পাথরে পাথরে। তারই ধারে তো খাদ-দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে-আসা যাত্রীদের রাতের ঠিকানা তখন। তনুশ্রী আর ভরতের একটা দারুণ নাটকীয় দৃশ্য টেক করার তোড়জোর চলছিল। সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার ট্রলি পেতে ক্যামেরা বসানোর গোছগাছ করছেন। আর সবে এক গ্লাস গরম চায়ে চুমুক দিয়েছেন পরিচালক, একজন প্রোডাকশান কর্মী কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। বললেন, ‘কৌশিকদা, সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড। চিতা বেরিয়েছে। চিতা!” কৌশিক শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঘোষণা করলেন, কেউ যেন একা শ্যুটিং ‘জোন’ ছেড়ে কোথাও না যান।
জানা গেল জেনারেটর অপারেটর কমল রায় পাহাড়ের জঙ্গলের ভেতর অনেকক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পা ধরে যাওয়ায় একটু হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন।
এমন সময় পেছনে শোনেন কীসের যেন পায়ের শব্দ, আর ঝোপঝাড়ের খসখস।
পিছু ফিরতেই দেখেন জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে একটা চিতা দাঁড়িয়ে।
“আর কিছু না ভেবে পড়ি কি মরি করে আমি আমার সঙ্গে আর একজন যে অপারেটর আছে, দু’জনে মিলে দে ছুট। ছুটতে ছুটতে নেমে এসেছি পাহাড় থেকে। পুলিশও বলেছে ওপরের জঙ্গলে চিতা আছে নাকি!” চিতা নিয়ে একটা রোমাঞ্চের ছোঁয়া লাগল ইউনিটে।
এক দিকে চলছে শ্যুটিং। আর এক দিকে অসহ্য ঠান্ডা এড়াতে আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল আড্ডা। আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন মেক আপ আর্টিস্টরাও। গার্গী গান ধরলেন গুনগুন করে। কমলেশ্বর গল্প করছিলেন অর্ধেন্দুর সঙ্গে। অর্ধেন্দু এই ছবিতে ফাদারের ভূমিকায়। পাশে বসে শিশুশিল্পী প্রত্যয় বসু। চিতা নিয়ে তার তখন অনেক প্রশ্ন। সবেরই উত্তর দিচ্ছিলেন পল্লবী। হঠাৎ বলে উঠলেন ‘‘আচ্ছা ত্রিধা কোথায় গেল?’’ কে যেন বললেন, ‘‘ও তো ফ্রেশ হতে গিয়েছে। ফিরে আসবে এখনই।’’ আবার খানিক বাদে পল্লবীর একই প্রশ্ন, ‘‘ত্রিধা ফিরল না তো?’’ রুদ্রনীল বললেন, “আরে মাকুদি (পল্লবীর ডাকনাম) চিতা নিয়ে যায়নি ওকে। সাহেবও তো সঙ্গে গিয়েছে।” ত্রিধা ফিরে আসায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন পল্লবী। যাক, মেয়েটা প্রাণে বেঁচে ফিরল। ছবিতে ত্রিধা যে তাঁর মেয়েরই চরিত্রে। আগলে রাখতে হবে তো! ভাবটা এমনই পল্লবীর। পল্লবী-কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়-ত্রিধা-আর ক্লাস ফাইভের ছাত্র প্রত্যয়-এঁরা চার মিলে এই ছবিতে একটা পরিবার। |
|
|
তনুশ্রী ও ভরত |
মিমি ও সাহেব |
|
শিং ভেঙে বাছুরের দলে |
শিল্পী-কলাকুশলী মিলিয়ে একশো কুড়ি জনের ইউনিট। তাঁদের নিয়ে পাথুরে নদীশয্যায় হইহই-রইরই। পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে ইউনিটের নানা ধরনের কুড়িটা গাড়ি। তাতেই রোজ আসা- যাওয়া ইউনিটের সকলের। আসত খাবারদাবার, শ্যুটিংয়ের মালপত্র,বাজার থেকে কেনা জিনিসপত্র। একশো কুড়ি জনের থাকার ব্যবস্থায় জোরথাংয়ের সাতটা হোটেলের প্রায় সব ঘরই বুকড। সে যেন রাজসূয় যজ্ঞ।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে বাকি পনেরো জন শিল্পী, যে সব সময় শ্যুটিংয়ের দৃশ্যে থাকছিলেন তাও নয়। তবুও একসঙ্গে বসে থাকতেন সারা দিন। সকাল আটটায় শ্যুটিং শুরু হত। শেষ হতে হতে রাত বারোটা-একটা। কারও যেন ক্লান্তি নেই। ঘুম নেই। আছে শুধু ভাল পারফরম্যান্স দেখাবার অদম্য ইচ্ছে। সেই জন্যই লিলির মতো বর্ষীয়ান শিল্পী বহু ছবি করার পরও পৌঁছে গিয়েছিলেন ‘খাদ’য়ের শ্যুটিংয়ে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে একটা মাত্র চাদর জড়িয়ে দিব্যি বসেছিলেন। হেসে বললেন, “আমার চরিত্রটার মধ্যে খুূব তারুণ্য আছে। এখানে কত অল্পবয়সি সব আর্টিস্ট। আমিও তো শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকে ওদের সঙ্গে গল্পে মাতি। নিজের বয়সের কথা মনেই থাকে না।”
সে দিন সকালে তাঁবুর ভেতরে একটা দৃশ্য। যেখানে গার্গীও ছিলেন লিলির সঙ্গে। গার্গী একজন সুপারস্টার অভিনেত্রী হয়েও বাসে উঠেছিলেন একটা বিশেষ কারণে। বিপদের পর সমস্ত তারকাসুলভ সীমারেখা মুছে লিলির মতো বৃদ্ধা সহযাত্রীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন তিনি। ছবিতে ক্যানসার-রুগি লিলি যেন জীবনের প্রতীক। গার্গীকে বলেন, “আয়নাটা দাও তো।’ আয়নায় মুখ দেখে গার্গীরই দেওয়া লিপস্টিক লাগান। বাঙাল ভাষার সংলাপে বলেন, অসুখ হয়েছে তো কি? যে ক’দিন বাঁচবেন ভাল করে বাঁচবেন। লিলি আর গার্গীর একটা অসম্ভব সংবেদনশীল মুহূর্ত গড়ে উঠেছিল তাঁবুর ভেতর।
শট শেষ হলে পরিচালক বলে ওঠেন ‘অসাধারণ। লিলিদি।’ তার পরে আপন মনে মনিটরের সামনে বসে বলেন ‘কী অভিনয়, কী রিঅ্যাকশন! জাস্ট ভাবা যায় না। এখনও....এই বয়সেও!’ একটু সরে এসে গার্গী আবেগভরা গলায় বললেন, “লিলিদির অভিনয় এমন মাস্টারস্ট্রোক যে আমাকে প্রতিটা এক্সপ্রেশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন একটা অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছি।” |
কাছে তবু কাছে নয় |
রাতে কনকনে ঠান্ডা। দুপুরে গনগনে রোদ। ছাউনির নীচে জমিয়ে চলেছে শিল্পীদের আড্ডা। অল্পবয়সিরা নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে মাতেন। সব থেকে বেশি ফাজলামো করছিলেন রুদ্রনীল আর সাহেব। তাঁদের কথায় সবাই হেসে কুটিপাটি। মাঝে মাঝে আড্ডার মেজাজটাই বদলে যেত, যখন উত্তম-সুচিত্রার গল্প, ‘আলাপ’ আর ‘চুপকে চুপকে’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অভিনয়-অভিজ্ঞতার গল্প, পুরনো দিনের বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভেতরকার অজানা কাহিনি রসিয়ে রসিয়ে বলতেন লিলি। ভরদুপুরে হঠাৎ দেখা গেল এক ছাতার তলায় রুদ্রনীল আর পল্লবী বসে দারুণ ঘনিষ্ঠ ভাবে। এমনকী কথা যে এত কানে কানে বলতে হয়? কান পাততেই বোঝা গেল রুদ্র একটা নিজের লেখা নাটক বা সিনেমার গল্প বলছেন। কিন্তু তার জন্য এত গলায় গলায় ভাব?
জীবন তো এই রকমই। অনেক ঘনিষ্ঠতার পরেও ভুলে যেতে হয় কত পুরনো কথা। আবার কখনও এক লহমায় বন্ধু হয়ে যায় দুটো মানুষ। তা না হলে একই আউটডোরে হাজির সেই রুদ্রনীল-তনুশ্রী। যাঁদের সম্পর্ক একটা সময় ইন্ডস্ট্রির বহু আলোচিত গল্প সেই তাঁরা এত কাছে থেকেও কেমন পুরনো টান চাপা দিয়ে শুধু অভিনয় নিয়ে টুকটাক কথা বলেন মাঝে মাঝে। অতি সন্তর্পণে তনুশ্রী এড়িয়ে যান রুদ্রনীলের উপস্থিতি। কখনও চোখে পড়ল তনুশ্রী খুব কাছাকাছি চেয়ারে বসে আর কারও সঙ্গে কথা বলছেন, সচকিত হয়ে উঠতেন রুদ্রনীল। |
গার্গী ও রাজদীপ |
পরিচালক যখন অভিনেতা |
সবাই প্রচুর আড্ডা মারলেও কৌশিক আর সৌমিক কিন্তু কোনও আড্ডায় নেই। আড্ডায় নেই রাজদীপও। যিনি ছবিতে গার্গীর ভাই। আর ছবির বাইরে কৌশিকের সহকারী। সব সময়ই তাঁরা শ্যুটিং নিয়ে ব্যস্ত। এমনকী খেতে বসতেন দূরে একটা জায়গায়। সেখানে মাঝে মাঝে থাকতেন কমলেশ্বর আর ভরত। ভরত অবশ্য কখনওবা লোকেশন থেকে উধাও হয়ে যেতেন। তার পর হঠাৎ ফিরে আসতেন। রোজই এমন হত। কোথায় যান উনি? “আমি কিছু মেল পাঠানোর জন্য হোটেলে যাই,’’ হেসে বলেছিলেন ভরত। আসল কথা তিনি এই ছবির লাইন প্রোডিউসরও। প্রশাসনিক কাজগুলোও যে তাঁকে ফাঁকে তালে সেরে আসতে হত শ্যুটিংয়ের ফাঁকেই টাইম ম্যানেজ করে।
তার পর মেতে ওঠেন আবার অভিনয়ে। ভরত ছবিতে একজন ডাক্তার। বললেন, “আমি চরিত্রটায় ডা. রাজীব শীলের মতো একটা প্লেজেন্ট লুক দেওয়ার চেষ্টা করেছি।” একটার পর একটা দৃশ্য যেন ক্রমশ কাছাকাছি নিয়ে আসছে অচেনা-অজানা সহযাত্রীদের। খাদের কিনারা থেকে ফিরে তারা যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে সম্পর্ক আর কাছের মানুষকে। কখনও তিক্ততা, কখনও কথা কাটাকাটি, কখনও অবাধ্য চোখের জল, কখনও বা একটুখানি হাসি।
কিন্তু ব্যাকড্রপে দাঁড়িয়ে আছে সেই মৃত্যু!
মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও ছবির গল্পে সাহেব আর মিমি যেন হনিমুন কাপল। বেশির ভাগ দৃশ্যেই ক্যামেরার সামনে তাঁরা পাশাপাশি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই প্রায় ভেস্তে যাওয়ার জোগাড় হল যে হঠাৎ।
একটা সিন করতে গিয়ে পাথরে বেজায় হোঁচট খেয়ে বসে পড়লেন মিমি। আর উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। এত ব্যথা। প্রোডাকশনের কর্মীরা দৌড়ে এসে ভোলিনি লাগিয়ে দিলেন পায়ে। তনুশ্রী তাঁকে ধরে তুলে টেনে বসালেন চেয়ারে। ডাক্তারবাবু কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এসে নিদান দিলেন, “কোনও কড়া পেন কিলার খাওয়ানো যাবে না। অসুবিধে হতে পারে। সাধারণ ব্যথা কমার ওষুধ খেয়েই চলুক। যদি ফোলা বা ব্যথা বাড়ে তা হলে কাল সকালে এক্স-রে করাতেই হবে।”
পরের দিন এক্স রে করে জানা গেল পা মচকে গিয়েছে মিমির। ভাঙেনি। কমলেশ্বরের তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। এক সন্ধ্যায় বনফায়ারের সামনে বসে কমলেশ্বর বলছিলেন তাঁর ডাক্তারি জীবনের নানা অভিজ্ঞতার গল্প। “একবার চলন্ত ট্রেন থামিয়ে বাচ্চা ডেলিভারি করাতে পর্যন্ত হয়েছিল। কী করব? আমি তো মেডিসিনের ডাক্তার। কিন্তু সেই ভদ্রমহিলার এমন অবস্থা, বাধ্য হয়ে আমাকে পাশে থাকতে হল। অবাঙালি পরিবার। ছেলে হওয়ার পর কি খুশি! পুরো ট্রেনকে লাড্ডু খাইয়েছিল। কিন্তু আমি বলেছিলাম মা আর বাচ্চাকে পরের স্টেশনের কাছাকাছি কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত একবার। সেটা ওঁরা নিয়ে গেলেন না।” কিন্তু কেমন লাগছে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে? কমলেশ্বরের বক্তব্য ছিল, অভিনয়ের দিকে কখনওই তেমন ঝোঁক ছিল না। তাঁর কাছে প্রাপ্তি এত জন শিল্পীর সঙ্গে এত দিন আউটডোরে থাকতে পারাটাই। |
নদীর ধারে বাগদেবী |
রামবাংয়ের ধারে সব থেকে কঠিন ছিল একটা দীর্ঘ দৃশ্য, যেখানে ছবির ষোলো জন চরিত্র থাকবে একই সিনে। এমনকী পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন সেই দৃশ্যে। যেহেতু তিনিও একজন বাসযাত্রী। এবং ছবিতে সম্পর্কে লিলির ছেলে। দেড় ঘণ্টা ধরে ভরদুপুরে একটাই দৃশ্য শ্যুট করা হল। ছবির সব চরিত্র এক দৃশ্যে। সৌমিকের ক্যামেরা ঘুরে গেল তিনশো ষাট ডিগ্রি। একাধিক বার রিহার্সালের পর শ্যুটিং যখন শেষ হল তখন বেলা সাড়ে চারটে। সূর্য ডুবু ডুবু। আবার ঠান্ডা নামছে। কেন যে পরিচালক কৌশিক ছবির দর্শককে পাহাড়ে নিয়ে যান বারবার? ‘ল্যাপটপ’, ‘ওয়ারিশ’, ‘কেয়ার অব স্যার’, ‘শব্দ’, ‘জ্যাকপট’ সব ছবিতেই পাহাড় যেন একটা চরিত্র। “কী করব? পাহাড়ের সঙ্গে যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার। চূর্ণীকে বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গেই। ও তো পাহাড়েই বড় হয়েছে,” দুষ্টুমি ভরা হাসিতে বলেন কৌশিক।
শেষে একটা মজার ঘটনা না- বললেই নয়। পাহাড়ে নির্বাসিত হলেও শিলিগুড়ি থেকে সরস্বতী প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জোরথাং। নদীর ধারে ক্যামেরা বসানোর টুলে ঠাকুর বসিয়ে পুজো। পুরোহিতও এসেছিলেন শিলিগুড়ি থেকে। মেনুতে ছিল খিচুড়ি, বেগুনি, ফুলকপির ডালনা, পায়েস।
ভরত বললেন, “একেই বলে জঙ্গল মে মঙ্গল!” ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের পর হাল আমলে বাংলা ছবির সবচেয়ে আলোচিত, তারকাখচিত আউটডোর শেষ করে টালিগঞ্জের শিল্পীরা প্রায় বাড়ি ফেরার পথে। খাদের ধারে আটকে -পড়া বাসযাত্রীরা একরাত এক সঙ্গে কাটিয়ে জীবনকে নতুন ভাবে জানার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল। তাদের সামনে ছিল মৃত্যুর পরোয়ানা। কিন্তু টালিগঞ্জের শিল্পী-কলাকুশলীরা এক পক্ষকাল এক সঙ্গে কাটিয়ে কী নিয়ে ফিরে আসছেন? শুধুই একটা সম্ভাব্য ভাল ছবির শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা?
নাকি এই পনেরো দিন হয়ে
থাকবে জীবনের দীর্ঘতম চড়ুইভাতির উদ্দাম এক স্মৃতি?
|
খাদের মেনু |
• উত্তম-অমিতাভের গল্প বলা
লিলিদির সঙ্গে প্রচুর আড্ডা
• চুপিসারে পিএনপিসি
• মিনারেল ওয়াটারের বোতলে ঢুকু ঢুকু ব্র্যান্ডি
• পালা করে বনফায়ারে কাঠ জোগানো
• টুনির মা’ জাতীয় গান ক্ল্যাসিক্যাল সুরে গাওয়া
• হঠাৎ দলছুট হয়ে দার্শনিক দার্শনিক ভাব করা
• একে অপরের মিমিক্রি করা
• গুজগুজ, ফুসফুস
• পরষ্পরকে নানান সুরে ‘সিস্টার...সিস্টার’ বলে ডাকা, এবং ফিকফিক হাসি (যার পিছনে ছিল প্রচণ্ড রসালো সত্যিকারের একটা ‘অ্যাডাল্ট’ গল্প) |
|
|
|
|
|
|