গাঢ় বাদামি রঙের পরদা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে প্রথমে যে একটু অস্বস্তি হয়নি এমন নয়। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর সেটা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। টেবিলের উপর হাতে লেখা অভিযোগপত্রটা রেখে সাহস করে কথাটা তিনি পেড়েছিলেন খোদ এসডিপিও’র কাছে। জানিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও মেয়ের যৌতুকের জিনিসপত্র তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে পাক্কা দশ হাজার টাকা ‘খরচা’ চেয়ে বসেছেন জলঙ্গি থানার এক এএসআই। তারপর সেই ঘুষ চাওয়া প্রমাণ করতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘একটা ফোন করব স্যার? আপনি শুধু ও প্রান্তের কথাগুলো একটু শুনবেন।’’
অভিযোগপত্রটি হাতে নিয়ে অবাক হয়েই ওই বৃদ্ধের দিকে তাকিয়েছিলেন ডোমকলের এসডিপিও অরিজিৎ সিংহ। মোবাইলের লাউড স্পিকারে ততক্ষণে বেশ চড়া গলায় ভেসে আসছে, “বারবার এত ফোন করার কী আছে? বলেই তো দিয়েছি, দশ হাজার টাকার দশ পয়সা কম হলেও কাজ হবে না। থুতু দিয়ে আগে টাকা গুণে নেব। তারপর কাজে হাত দেব...।”
হাতের ইশারায় ফোনটা কেটে দিতে বলে এসডিপিও বলেছিলেন, “ঠিক আছে, দেখছি কী করা যায়।” খুব বেশি দিন অবশ্য দেখতে হয়নি। বুধবারের ওই ঘটনার পর শুক্রবারেই ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছে জলঙ্গি থানার এএসআই মানিক দত্তকে। শনিবার ইসলামপুরের নলবাটরা গ্রামের সত্তর ছুঁইছঁই কুড়ান শেখ বাড়ির দাওয়ায় বসে হাসতে হাসতেই বলছেন, “দেখেছেন, বাপেরও বাপ থাকে।”
বছর দুয়েক আগে কুড়ান শেখের মেয়ের বিয়ে হয় জলঙ্গির ফরিদপুর গ্রামে। বিয়েতে যৌতুক হিসাবে দেওয়া হয় নগদ টাকা, সাইকেল, গয়না ও আসবাবপত্র। কিন্তু বিয়ের বছর দেড়েক পর অশান্তির কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ও যৌতুকের সামগ্রী ফেরত চেয়ে মেয়েকে নিয়ে ডোমকল মহকুমা আদালতের দ্বারস্থ হন কুড়ান। এক মাস আগে আদালত যৌতুকের ওই জিনিসপত্র পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
অভিযোগ, সেই নির্দেশ পালন করা তো দূরের কথা, উল্টে তদন্তকারী অফিসার মানিক দত্ত ওই বৃদ্ধের কাছে দশ হাজার টাকা ঘুষ চান। না দিলে কোনও কাজ করবেন না বলেও হুমকি দেন তিনি। স্থানীয় ইসলামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ছিলেন কুড়ান শেখ। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি অবসর নেন। শান্তিপ্রিয় মানুষ বলেই এলাকার লোক তাঁকে চেনেন। তবে জলঙ্গিতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর থেকে নানা অশান্তির কারণে তিনি বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। সেই অশান্তি থেকে মেয়ে ও তাঁর পরিবার নিষ্কৃতি পেতে ডোমকল মহকুমা আদালতে মামলাও করেছিলেন। কিন্তু গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো উপস্থিত হয়েছিল আর এক উটকো ঝামেলাঘুষ। কুড়ান বলছেন, “এত বছর চাকরি করলাম। পয়সা তো দূরের কথা, কারও কাছে একটা বাড়তি সুবিধা পর্যন্ত নিইনি। সামান্য বিড়িটা পর্যন্ত নিজের পয়সায় কিনে খেয়েছি। আর আদালতের নির্দেশ পেয়েও ওই পুলিশকর্মী বলেন কী না দশ হাজার টাকা লাগবে!”
নবাবি মেজাজে বিবিকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে কুড়ান বলে চলেন, “জানেন, কেমন একটা জেদ চেপে গেল। ভাবলাম, যাই হোক না কেন একটা পয়সাও ঘুষ দেব না। সাহস করে মোবাইল আর অভিযোগপত্রটা হাতে করে সোজা চলে গেলাম এসডিপিও সাহেবের অফিসে। নিজের মোবাইল ফোনের লাউড স্পিকার অন করে দিয়েছিলাম। মানিকবাবু কী ভাবে ঘুষ চাইলেন সে কথা সাহেব নিজে কানেই শুনেছেন। অভিযোগটা তো তার আগেই দিয়ে দিয়েছি।”
ডোমকলের এসডিপিও অরিজিৎ সিংহ বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মেলায় শুক্রবার মানিক দত্ত নামে ওই এএসআইকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও হবে।’’ আর ওই এএসআই, মানিকবাবু অবশ্য ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলছেন, “কেন আমাকে সাসপেন্ড করা হল সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
ডিসেম্বরে মুর্শিদাবাদ সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী জেলার পুলিশ সুপারকে তোলাবাজি নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তার কিছুদিন পরেই ফরাক্কায় লরি চালকের কাছে তোলাবাজির অভিযোগে চার পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ফের সাসপেন্ড করা হল জলঙ্গি থানার এই এএসআইকেও। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, “ঘুষ কিংবা তোলাবাজির ঘটনা কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।” “আর কুড়ানের মতো এক আটপৌরে বৃদ্ধ এক সাদা-কালো মোবাইলকে কাজে লাগিয়ে যা ভেল্কি দেখাল তাতে ঘুষ নিতে গিয়ে অনেককেই এখন আগাপাশতলা ভাবতে হবে”বলছিলেন এসডিপিও অফিসের এক পুলিশকর্মী।
|