তাঁরা দু’জন সত্যিই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন কি না, তা নিয়ে ধন্দ কাটেনি। তবে, যোগ যে দেবেন, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট তৃণমূল সূত্র থেকে। রাজ্যসভার নির্বাচনে তাঁরা দু’জন তৃণমূলের প্রার্থীদের হয়েই ভোট দিয়েছেন। আর তা জানাজানি হতেই দুই বিধায়কের এলাকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। আবার পুরো পর্বকে ঘিরে সংশয় কাটেনি দলীয় কর্মীদের একটা বড় অংশের মধ্যে।
ওঁরা দু’জনমালদহের গাজলের কংগ্রেস বিধায়ক সুশীল রায় এবং জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির আরএসপি বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারী। দলীয় বিধায়ক দলকে কোন কিছু না জানিয়ে রাজ্যসভায় তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় মালদহ জেলা কংগ্রেস সভাপতি মৌসম বেনজির নূর শুক্রবার বলেন, “আমার সাংসদ এলাকার বিধায়ক এ ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, ভাবতেই পারছি না! এই ঘটনায় আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। এ দিন সকাল থেকে গাজলের প্রচুর মানুষ ও দলের কর্মীরা আমাকে ফোন করে সুশীল রায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন।” মৌসমের বক্তব্য, “দল ছাড়ার কথা জানতে পারলে ওঁকে ডেকে নিয়ে আলোচনা করতাম।” কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আবু হাসেম খান চৌধুরীর অভিযোগ, “প্রলোভনে পড়ে গিয়ে সুশীল তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন।”
আজ, শনিবার সুশীলবাবুর বিরুদ্ধে গাজল ব্লক কংগ্রেস ধিক্কার মিছিল বের করবে বলে দল সূত্রের খবর। জেলা কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সৌমিত্র রায় বলেন, “সুশীল রায় যে দিন গাজলে ঢুকবেন, সে দিন কংগ্রেস ওঁকে কালো পতাকা দেখাবে।” তাঁর চ্যালেঞ্জ, “যদি ক্ষমতা থাকে, তবে সুশীলবাবু বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূল প্রার্থী হয়ে গাজল থেকে জিতে দেখান!” গাজল ব্লক কংগ্রেস সভাপতি তামিজুদ্দিন আহমেদের মন্তব্য, “এ ভাবে কংগ্রেস ছেড়ে উনি চলে যাবেন, ভাবতে পারছি না।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র বলেন, “মানুষ দু’টি কারণে দল বদল করে। এক ভয়, দুই টাকার লোভে। রাজ্যসভার ভোটে ভয় দেখানোর প্রশ্নই নেই। বাকিটা বুঝে নিতে হবে।”
ক্ষোভ ছড়িয়েছে সুজাপুরের কংগ্রেস বিধায়ক আবু নাসের খান চৌধুরী তথা লেবুবাবুর ভূমিকা নিয়েও। জেলা কংগ্রেসের আর এক সাধারণ সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারির দাবি, “আবু নাসের ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যালট পেপারে সই করে কংগ্রেসকে বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। আবার তৃণমূল নেতাদের বলছেন, তিনি কংগ্রেসকে ভোট দেবেন না বলেই ব্যালট পেপারে সই করেছেন। আবু নাসের দুই নৌকায় পা রেখে রাজনীতি করছেন।”
আরএসপি বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারীকে নিয়ে ধন্দ ও সংশয় তুঙ্গে ময়নাগুড়িতে। জেলা নেতৃত্বের একাংশ দলের ভাঙন ঠেকাতে শুক্রবার কয়েক দফায় আলোচনায় বসে রণকৌশল ঠিক করতে ঘাম ঝরালেও কর্মীদের অনেকে বিধায়কের হাত ধরে দলত্যাগ করার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে রবিবার দলের জোনাল কমিটির বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। বণিকসভার কর্মকর্তা থেকে বিভিন্ন পেশার বেশির ভাগ ভোটদাতা মনে করছেন, এলাকার উন্নয়নের জন্য ময়নাগুড়ির রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তন জরুরি ছিল।
এ দিন সকাল থেকেই ময়নাগুড়ির আরএসপি নেতা-কর্মীরা বিধায়কের দলত্যাগের ঘটনা সত্যি কি না, জানতে আরএসপি-র জোনাল দফতরে ভিড় করেন। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, কী এমন ঘটল যে, বিধায়ককে এ ভাবে তৃণমূলে চলে যেতে হল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেও উত্তর না-পেয়ে ওই নেতা-কর্মীদের দলীয় দফতর থেকে চলে যেতে হয়েছে। ময়নাগুড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক অতুল রায়ের অভিযোগ, “টাকার জন্য বিধায়ক দলকে বিপাকে ফেলে চলে যাবেন ভাবতে পারিনি।” জোনাল কমিটির সদস্য দীনবন্ধু রায়ের এক অভিযোগ।
দল যে তিনি ছাড়ছেনই, তা স্পষ্ট করে দিলেও অনন্তবাবু কিন্তু টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে টেলিফোনে তিনি বলেন, “ওঁদের সমস্ত যুক্তি ফুরিয়েছে। তাই এ সব বলছেন।” তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “১৯৭৭ সালের পর থেকে তো ময়নাগুড়ি বিধানসভা আরএসপি-র দখলে। নেতারা বুকে হাত রেখে বলুন সিপিএম উন্নয়নের কোন কাজ স্বাধীন ভাবে করতে দিয়েছে?” দলের পক্ষ থেকে দশ বছর আগে পুরসভার দাবি করা হলেও সিপিএমের বাধায় তা এত দিনে হয়নি বলে অনন্তবাবুর অভিযোগ। বিধায়কের দাবি, “বামফ্রন্ট আমলে ময়নাগুড়ির উন্নয়নের কাজ সহজে করা যেত। কিন্তু, সিপিএম চায়নি তাই হয়নি। কাজগুলি করার জন্য দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।” সিপিএম ময়নাগুড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক অরুণ ঘোষ ওই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “প্রতারকের একটি কথার উত্তর দেব না।”
তবে ঘটনা হল আরএসপি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, প্রভাবশালী নেতা অনন্তবাবুর দলত্যাগের ঘটনায় দলীয় কর্মীরা কিছুটা দিশেহারাই। |