থানার সামনেই নিমগাছের ছায়া ছড়ানো বেদিটায় বসতে গেলেই এগিয়ে আসছেন খাঁকি পোশাক।
গম্ভীর মুখে জারি করছেন ফরমান, “তেও থানাকো সামনে ভিড় না করনুস।” উঠতে দেরি করলে তাঁর খাটো লাঠি উঁচিয়ে শাসিয়ে দিচ্ছেন, “ইয়া ওয়ারা হাটো, হাটিয়ালো ...।”
নাঃ, শুক্রবার সকাল থেকে কাঁকরভিটা থানার সামনে দু -দণ্ড দাঁড়ানোর জো নেই।
ভারতীয় সীমান্তে নেপালের নির্জীব এই থানার চেহারাটাই গত দু’দিন ধরে বদলে গিয়েছে। নীল -লাল আলো লাগানো বড়বাবুর সবেধন জিপসির বাইরে এ থানার বাসিন্দারা পুলিশের গাড়ি তেমন দেখেননি। তবে গত ক’দিনে সেখানে অনর্গল ভিড় করছে ঝকঝকে জিপসি। আসছে সেনা -জিপ। হুটার বাজানো স্করপিও। শীতের মেচিতে তেমন জল নেই। সাঁকো পেরিয়ে ওপারের ভারতবর্ষ থেকেও আসছেন পুলিশ কর্তারা। সব মিলিয়ে একেবারে সরগরম কাঁকরভিটা। যা দেখে স্থানীয় আম -জনতার স্থির বিশ্বাস, থানায় নির্ঘাৎ কারও ‘আগমন’ ঘটেছে। কিন্তু তিনি কে? কৌতূহলী মুখের ভিড়টা তাই থানার সামনে জমে উঠলেই লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসছেন কনস্টেবল যুবকটি, “হাটিয়ালো, জলদি হাটিয়ালো।” থানায় অভিযোগ নিয়ে এলেও প্রবেশ পথেই হাজারো প্রশ্নের ধাক্কা। তা সামলে উঠতে পারলে প্রবেশাধিকার মিলছে বটে, তবে ডিউটি অফিসারের চেনা ঘরে নয়। পাশের অন্য একটি ঘরে কোনও রকমে দায়সারা করে অভিযোগ নথিবদ্ধ করেই প্রায় ঠেলেঠুলে থানা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ডিউটি অফিসারের ঘরের সামনে এখন কার্বাইন হাতে সেনা মোতায়েন। আর এতেই সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
কাঁকরভিটার থানার গায়েই এত দিন চা বিক্রি করতেন এক যুবক। সকাল থেকে তাঁর বিক্রি মাথায়। মুখ বেজার করে বলছেন, “কাকপক্ষীও বসতে দিচ্ছে না। থানায় এসে লোক চা খাবেন কখন ! ” তারপর চোখের ইশারায় জানতে চাইছেন, “আন্দার কৌন হ্যায়? মনে তো হচ্ছে কোনও বড় জঙ্গি।”
কিছুদিন আগে নেপাল সীমান্ত থেকে দুই কেএলও নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ‘লিঙ্কম্যান’ সন্দেহে হাতকড়া পড়েছিল রামশঙ্কর বসাকের হাতেও। কাঁকরভিটার ধূলাবাড়ি এলাকায় ফুচকা বিক্রি করতেন রামশঙ্কর। আদতে জলপাইগুড়ির টাকিমারির ওই বাসিন্দার সঙ্গে জঙ্গি যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহ পুলিশের। রামশঙ্কর নেই। তাঁর জায়গায় থানার অদূরে এ দিন বিকেলে ফুচকা নিয়ে বসে ছিলেন নিতাই যাদব। তিনি বলেন, “ভাবতে পারেন, আমার মতো এক জন ফুচকাওয়ালার সঙ্গে জঙ্গি -যোগাযোগ। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
গত বাইশ বছর ধরে কাঁকরভিটা থানায় ঢোকার মুখেই ঠেলায় ফলের রস বিক্রি করেন শিবদাস প্রধান। শুক্রবার সকালে থানার কাছাকাছি আসতেই তাঁকে হলা হয় ‘দূরে হটো’। গালে হাত দিয়ে শিবদাস বলেন, “কেয়া আজব সা বাত হ্যায় সাব্ ! ” গত দু -দশকে তাঁকে এ কথা তো কেউ বলেনি। তাহলে থানার ভেতরে কে রয়েছে যার জন্য এমন আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা ! শিবদাস বলেন, “কাল দুপুর থেকেই দেখছি সব কিছু কেমন বদলে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করেও উত্তর মেলেনি। আমি ভাবছি ক’দিন দোকানই বন্ধ রাখব। কী ঘটছে বুঝতে পারছি না বাবা।” নেপাল লাগোয়া দার্জিলিং জেলার শেষ জনপদ পানিট্যাঙ্কি। তারপরেই মেচির উপরে সেতু। সীমানায় পুলিশ এবং সেনাও মোতায়েন রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক থাকায় নিরাপত্তা বা তল্লাশির বহর অন্য দেশের তুলনায় নগণ্য। এত দিন তাই দেখে এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দু’দেশের মধ্যে রিকশা -ঠেলাভ্যান থেকে শুরু করে পণ্যবাহী ট্রাকের অবাধ চলাচল। মেচি নদীর সেতু পার হয়ে নেপালে স্বাগত জানানোর কংক্রিটের তোরণের সামনে দাঁড় করিয়ে পণ্যবাহী গাড়ির কাগজপত্র নিয়ম মাফিক পরীক্ষা করা হয় মাত্র। |