‘দেশ’ নিবেদিত ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে শ্রোতারা রাত জাগেন সুরের সন্ধানে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রোতারা সুরপাগল। এ বারে বাষট্টিতম অধিবেশনটিতেও তাঁরা সুরের আকর্ষণে উপস্থিত ছিলেন। উস্তাদ রাশিদ খান শ্রোতাদের আপ্লুত করেন। গত কয়েক বার ডোভার লেনে তাঁর পরিবেশনা যান্ত্রিক বলে মনে হয়েছে। সমালোচকেরা অভিযোগ করেছেন, ওঁর গানে বৈচিত্রের অভাব রয়েছে, পুনরাবৃত্তিও রয়েছে। রাশিদ বুদ্ধি দিয়ে গান না, হৃদয় দিয়ে গান। তার সঙ্গে ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ যোগ করলে শ্রোতারা তো পাগল হবেনই। এই অধিবেশনে রাশিদের ললিত, আহির ভৈরব এবং ভৈরবী এ বারের ডোভার লেনে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তির অন্যতম।
|
বর্তমানে কণ্ঠসঙ্গীতে মহারাষ্ট্রের শিল্পীরা নজর কাড়ছেন। কৈবল্যকুমার গৌরব, বেঙ্কটেশ কুমারের সঙ্গে এ বার আর-একটি নাম যুক্ত হল। বিনায়ক টোরভি। গায়কিতে গঙ্গুবাঈ হাঙ্গল ও ভীমসেন যোশীর প্রভাব রয়েছে, তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠে মিঞা মল্লার, তিলক কামোদ ও বসন্তবাহার অতি সুখশ্রাব্য। আর-একজন মহারাষ্ট্রীয় শিল্পী জয়তীর্থ মেভুন্ডী যোগকোষ ও ভজন পরিবেশন করেন। তবে তাঁর গান গতবারের মতো ভাল হয়নি। প্রবীণ শিল্পী পূর্ণিমা সেন আগরা ঘরের ধারক ও বাহক। তাঁর গান শোনাই শিক্ষার স্বরূপ। ইনি বেহাগড়া ও রায়েসা কানাড়ার অনেকগুলি খানদানি বন্দিশ পরিবেশন করেন। শ্রুতি সাদোলিকরও বেহাগড়া পরিবেশন করেছেন। তবে আমরা এর আগে সাদোলিকরের আরও ভাল গান শুনেছি।
কৌশিক ভট্টাচার্যের জয়জয়ন্তী মন্দ নয়। কিন্তু ওঙ্কার দাদারকর সঠিক শিক্ষার পরিচয় দেন।
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী ভিন্ন ষড়জ অথবা কৌশিকধ্বনি অথবা হিন্দোলি পরিবেশন করেন। পরে তিনি ঠুমরিও গান। তবে আগের মতো মন কাড়তে পারেননি।
এ বারের ডোভার লেন অধিবেশনে, ইমদাদ খান-ইনায়েত খান-বিলায়েত খান ধারায় দুই সেতারি দাগ কেটেছেন। উস্তাদ শাহিদ পারভেজ ইমদাদ খানের প্রপৌত্র। তাঁর বাজনায় এই উত্তরাধিকার স্পষ্ট। তাঁর পরমেশ্বরী শুনতে ভাল লেগেছে। গুর্জরী তোড়িতে তাঁর তানকারি ও লয়কারি আকর্ষক। এই ধারার আর-একজন শিল্পী অনুপমা ভাগবতের মালকোষ শ্রোতাদের চমকে দিয়েছে। তাঁর সাহানা কানাড়ার বন্দিশে উস্তাদ আমজাদ আলি খানের প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর হাত মিষ্টি এবং অসাধারণ তৈরি। এঁর অন্তর্ভুক্তির জন্য সংগঠকদের সাধুবাদ প্রাপ্য।
|
আর এক মহিলা সেতারি রবিশঙ্কর-কন্যা দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু তাঁর পরের শিল্পী শ্রুতিনন্দনও বটেন। কৌশিকী চক্রবর্তীর আগের কয়েকটি পরিবেশনা আমাদের হতাশ করেছিল। এ বারে তিনি বসন্তমুখারি রাগ গেয়ে শ্রোতাদের অভিযোগ মুছে দিয়েছেন। আমাদের আশা, ভারতের শ্রেষ্ঠ মহিলা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন। যদি তিনি সাধনায় স্থিতধী থাকেন। সরোদিয়া উস্তাদ আলি আকবর খানের পুত্র আলম খানের হাতটি ভারী মিষ্টি। তাঁর দরবারি কানাড়া ও কিরওয়ানি তাঁর বাবাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
কিন্তু তাঁর গুরুভাই রাজীব তারানাথের নটভৈরব চলনসই। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিতে ঝিঞ্ঝোটি ও হংসধ্বনি শ্রোতাদের মন কেড়েছে। রাহুল শর্মা সন্তুরে গোরখ কল্যাণ ও পাহাড়ি বাজান। মানে, সন্তুরে যতটা বাজানো যায়। পণ্ডিত যশরাজের ভৈরোঁবাহার তাঁর কণ্ঠমাধুর্যে শ্রোতাদের মন কেড়েছে। তাঁর ভজনও খুব জনপ্রিয়। |
এল সুব্রহ্মণ্যমের দক্ষিণী ঢংয়ের বেহালাবাদনে হংসধ্বনি চিত্তাকর্ষক। রনু মজুমদার ও মাইসোর মঞ্জুনাথের যুগলবন্দিতে ভাল বোঝাপড়া ছিল। তাঁরা সরস্বতী ও চারুকেশী বাজান। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, ভবানীশঙ্কর কথক, তিরুবারুর ভক্তবৎসলম ও ঘটম গিরিধর উদুপার তালবাদ্য চতুষ্টয় উপভোগ্য হয়েছিল। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্বের কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু ঘটম গিরিধর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উস্তাদ হাফিজ আলি খানের শিষ্যের পুত্র পুষ্পরাজ কোস্টির সুরবাহারে কেদার ও শঙ্করা তাঁর তালিমের পরিচায়ক।
বিভিন্ন দিনে শিল্পীদের সঙ্গত করেন তবলায় আনন্দগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সাহা, তন্ময় বসু, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজিত সাহা, শুভজ্যোতি গুহ, সঞ্জয় অধিকারী, রামকুমার মিশ্র, উদয়রাজ কারপুর, ইন্দ্রনীল ভাদুড়ী, বিভাস সাংহাই ও সন্দীপ ঘোষ। পাখোয়াজে ছিলেন সঞ্জয় আগালে। মৃদঙ্গমে জয়চন্দ্র রাও এবং ভি ভি রমণমূর্তি। হারমোনিয়ামে জ্যোতি গোহ, দেবপ্রসাদ দে, সনাতন গোস্বামী, মুকুন্দ পেটকর, গৌরব চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ পালিত ও রূপশ্রী ভট্টাচার্য। সারেঙ্গিতে ছিলেন সারাওয়ার হুসেন, আল্লারাখা কলাবন্ত। মর্সিংয়ে সত্যসাঁই ঘণ্টসালা। কণ্ঠসঙ্গীতে সহযোগিতা করেছেন তৃপ্তি মুখোপাধ্যায় ও বেহালায় সঙ্গত করেছেন অম্বি সুব্রহ্মণ্যম। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পারমিতা মুখোপাধ্যায়ের হারমোনিয়াম ও শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তবলা। |