পুরনো ঠিকানা ছেড়ে বছর আড়াই আগেই বিবাগী হয়েছিল তারা। গরুমারার চেনা বসত ছেড়ে তিস্তার চরে ঘাস বনে তাদের খোঁজ করতে গিয়ে অবশ্য অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বন কর্তারা।
গরুমারার দুই বিবাগী পুরুষ গন্ডার ‘ঘাড় মোটা’ ও ‘কান হেলা’ই নয়, সেখানে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে গরুমারার আরও গোটা দুই গন্ডারের। রয়েছে হরিণকুলের বিচরণ, বাইসনের অবাধ যাতায়াত। এমনকী মাঝে মধ্যেই সেখানে আস্তানা গাড়ছে চিতাবাঘও। লালটং থেকে গজলডোবা, প্রায় ৩৯ কিলোমিটার তিস্তা চর যেন সাজানো এক অভয়ারণ্যের চেহারা নিয়েছে।
নদীর কোল ঘেঁষা, উঁচু ঘাসের নিরুপদ্রব সেই পছন্দের ঠিকানা থেকে ওই দুই গন্ডারকে গরুমারায় ফেরানো যে সহজ নয়, তা বুঝেছিলেন বনকর্তারা। গরুমারা জাতীয় উদ্যান এবং বৈকণ্ঠপুর অভয়ারণ্যের মাঝে ওই বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলকে তাই স্বতন্ত্র এক সংরক্ষিত জঙ্গল হিসেবে চিহ্নিত করার কথা ভাবনা-চিন্তা সেই সময় থেকেই। এ ব্যাপারে দিল্লির কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। এ বার সেই বনাঞ্চলকে অন্তত ‘গন্ডার উপনগরী’ হিসেবে গড়ে তোলার কথা ভাবছে বন দফতর। |
রাজ্যের এক শীর্ষ বনকর্তা বলেন, “ওই এলাকা থেকে গন্ডার দু’টিকে সরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। কারণ ঘুমপাড়ানি গুলিতে তাদের কাবু করা গেলেও কর্দমাক্ত ওই ঘাস জমি থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের গন্ডারকে তুলে আনা কঠিনতম কাজ।” কারণ তিস্তা-চরের নরম মাটিতে ভারী গাড়ি প্রবেশের সুযোগ নেই। হেলিকপ্টারে তাদের অচৈতন্য দেহ উড়িয়ে নিয়ে গেলে কেমন হয়? সে প্রস্তাব কার্যকর করতে বছর দুয়েক আগে হেলিকপ্টার ভাড়া করে মহড়াও দিয়েছিল বন দফতর। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর কার্যকর করা যায়নি। গন্ডারকে দীর্ঘক্ষণ অচৈতন্য করে রাখাও সম্ভব নয়। তাই জোর করে ঘরে ফেরানোর চেষ্টায় পাছে গন্ডার দু’টি যদি মারা যায়, এই আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত পিছিয়েই এসেছিল বন দফতর।
কিন্তু অবাধ সেই বনাঞ্চলে এখন প্রায়ই পা পড়ছে চোরাশিকারিদের। বন দফতর সূত্রের খবর, অসম এবং নেপাল থেকে ওই ঘাস বনে আনাগোনা বেড়েছে তাদের। এলাকাটি কোনও নির্দিষ্ট সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এলাকাভূক্ত না হওয়ায় গন্ডার দু’টির নিরাপত্তা নিয়ে দিনভর উৎকন্ঠায় তাই বন দফতর। এলাকাটিকে তাই সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করাই এখন প্রাথমিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বন দফতরের। বন দফতরের এক কর্তা জানান, এলাকাটি বৈকুণ্ঠপুর বন বিভাগের আওতাভূক্ত হলে তিস্তার দুধারে গ্রামবাসীদের ওই পথে যথেচ্ছ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, নতুন বনাঞ্চল হলে সেখানে কর্মী-অফিসারও নিয়োগ করা যাবে। তাতে চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্যও কমবে।
বন দফতর সূত্রের খবর, বর্তমানে গরুমারায় গন্ডারের সংখ্যা অন্তত ৫৬টি। যার মধ্যে পুরুষ গন্ডারের সংখ্যাই বেশি। ফলে সঙ্গিনী দখল নিয়ে লড়াই লেগেই রয়েছে। মৃত্যুও ঘটছে। বিবাগী হয়ে জঙ্গলও ছাড়ছে অনেকে। তবে বিবাগী গন্ডাররা দিন কয়েক পরে বনেই ফিরে যায়। কিন্তু ‘কান হেলা’ ও ‘ঘাড় মোটা’ ব্যতিক্রম। প্রায় বছর তিনেক ধরে তারা ঘর ছাড়া। তিস্তার চর ছাড়িয়েও তারা এখন মাঝে মধ্যেই লাগোয় মহানন্দা অভয়্যারণ্যেও ঢুকে পড়ছে। পা রাখছে বন চিরে যাওয়া রেলপথেও।
বৈকন্ঠপুরের ডিএফও ধর্মদেব রাই বলেন, “চোরাশিকারির ভয় তো আছেই তা ছাড়া গন্ডার দু’টি এখন প্রায়ই রেলপথে উঠে পড়ছে। সংরক্ষতি এলাকায় ওদের না ঢোকাতে পারলে স্বস্তি নেই।” তাই দ্রুত ওই এলাকাটি সংরক্ষিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। নদীর কোলে ওই ঘাস জঙ্গলে বছরভর পাখির ভিড়। অন্তত ৪৪ প্রজাতির পাখিরও দেখা মেলে সেখানে। শীতে উড়ে আসে বিভিন্ন প্রজাতির রবিন, আর হুইশলিং টিল, পোচার্ড, ক্রেন, হেরন-সহ অন্তত সতেরো রকমের জলজ প্রজাতির পাখি। গন্ডারের উপনগরীতে তাই পাখিরালয় করা গেলেও মন্দ হয় না বলে মনে করছেন বনকার্তারা।
তিস্তা পাড়ের ওই এলাকার অধিকাংশই রাজ্যের সেচ দফতরের। এ ব্যাপারে তাই ওই দফতরের কাছে অনুমোদনও চাওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে শীঘ্রই সেচ দফতরের কাছ থেকে জমি চিহ্নিত করে এলাকাটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হবে বলে জানা গিয়েছে। অতিরিক্ত প্রধান মুখ্য বনপাল (উত্তরবঙ্গ) অনুপ সাহা বলেন, “তিস্তা সেচ প্রকল্প যখন তৈরি হয়, তখনই দুধারে ‘বার্ড স্যাংচুয়ারি’ গড়ার কথা ছিল। সেই সময়ে তা হয়নি। এখন তা জরুরি ভিত্তিতে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানে গন্ডারের বিচরণ ক্ষেত্রও তৈরি করা হবে। তা হলে গন্ডার দুটির উপরে নজরদারির সুবিধা হবে। জলদাপাড়া, গরুমারা, চাপড়ামারিতে গন্ডারের চাপ বাড়লে তাদের ওই বিচরণ ক্ষেত্রে পাঠানো যেতে পারে।” এ ব্যাপারে সেচ দফতরের নীতিগত সম্মতি রয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে গজলডোবায় তিস্তার উপরে ব্যারাজ তৈরির সময়েই সেখানে পাখিরালয়ের জন্য জমি দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছিল।
সম্প্রতি সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত রেল লাইন পাতার ব্যাপারে ছাড়পত্র দেওয়ার সময়েও ‘ন্যাশনাল বোর্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া’ ওই এলাকায় পাখিরালয় গড়তেই হবে বলে জানিয়েছে। বোর্ডের তরফে রাজ্যকে জানানো হয়েছে, সেবক থেকে মূলত টানেলের মধ্যে দিয়ে রেল লাইন গেলেও প্রচুর গাছ কাটা পড়ায় পাখিরা বিপন্ন হবে। তাই রেল লাইন পাতার আগে তিস্তার দু’ধারে ‘বার্ড স্যাংচুয়ারি’ গড়তে হবে।
|