দুঃখ আছে। আবার কোথাও রয়েছে সুখের হাতছানি। বঞ্চনা রয়েছে চরম। তবু মনের কোনে লুকিয়ে রয়েছে বেঁচে থাকার স্বপ্নও। সাহিত্য তো সমাজের দর্পন। তাই নাটকের মধ্যে এ সমাজ জীবনেরই নানা ছবি ফুটে উঠেছে। তবে তা উচ্চবিত্তের গগনচুম্বি বহুতলের কাহিনী নয়। বেশিরভাগই জল, জঙ্গল, মাটির কথা। আর এসব কাহিনী নিয়েই নাটক মঞ্চস্থ করতে হাজির হয়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
বাঁকুড়ার বড়গোড়া খেরোয়াল গায়েন গাঁওতা এবার ‘মনমি জিয়ন’ নাটক মঞ্চস্থ করলেন। মনমি জিয়ন কথা বাংলা অর্থ মানব জীবন। নাম মানব জীবন হলেও নাটকের মূল বিষয় হল, বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা। পরিবর্তে বৃক্ষরোপন করা। মানুষের রূপকে গাছ বাঁচানোর কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একই সঙ্গে বোঝানো হয়েছে, গাছ না বাঁচলে, পরিবেশ বাঁচবে না। তাহলে মানুষও বাঁচবে না। নাট্যদলের ম্যানেজার শ্যামাপদ হাঁসদার কথায়, “যে ভাবে চারদিকে বৃক্ষনিধন শুরু হয়েছে, তাতে ভবিষ্যত যে ভাল হবে না, তা সকলের কাছেই পরিষ্কার। নাটকের মাধ্যমে সেই বার্তাই দিতে চেয়েছি আমরা।” |
আদিবাসী ভাষায় ১৯তম রাজ্য একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার সূচনা হল শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র। |
গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে তা-ই নয়, জঙ্গলমহলের বহু পরিবারের জীবীকাও নির্বাহ হয় জঙ্গল থেকেই। কেউ শালপাতা বা কেন্দু পাতা তুলে, কেউ বা গাছের ডাল কেটে বিক্রি করে দিনের খাবার উপার্জন করেন। সেখানে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঢুকে অরন্য ধ্বংস করলে যে ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতির মধ্যে জীবন কাটাতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ভাবেই নানা বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে তিলাবনি চন্দন চম্পা মহিলা স্ব-সহায়ক নাট্যদল, বেনাগেড়িয়া হামদা গায়েন গড়, ডাঙরডিহি আদিবাসী সিসিত মালি গাঁওতা, গোপীবল্লভপুর জেটাড় গাওতা বা আদিবাসী খেরোয়াল গাওতা। কেউ মনমি জিয়ন মঞ্চস্থ করবেন তো কেউ নিয়ো দুলোড় দোয়া দিশম (এই ভালোবাসা, এই দেশ) বা চেঁড়ে (পাখি)।
শুক্রবার মেদিনীপুরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল আদিবাসী ভাষায় ১৯তম রাজ্য একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার। উদ্বোধনের দিনেই পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলার ৯টি দলের নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কথা। এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আকাশবাণীর সংবাদ পাঠক তরুণ চক্রবর্তী। সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শহর পরিক্রমা করে। যে শোভাযাত্রায় ছৌনাচ, পাতা নাচ, রণপা সহ রঙবেরঙের নানা দৃশ্য ছিল। তারপর বিদ্যাসাগর হলে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। প্রতিটি দলকে এক ঘন্টা করে সময় দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যেই নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। জঙ্গলমহলের তিন জেলা ছাড়াও বর্ধমান, বীরভূম, নদীয়া, শিলিগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি থেকে মোট ২৮টি দল অংশগ্রহন করার কথা। প্রথম থেকে তৃতীয় স্থানাধিকারীদের দেওয়া হবে নগদ আর্থিক পুরষ্কারও। প্রথম স্থানাধিকারী দল পাবে ২৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর জন্য ২০ হাজার ও তৃতীয় স্থানাধিকারীর জন্য রয়েছে ১৭ হাজার টাকা। এছাড়াও অভিনেতা-অভিনেত্রী ও পরিচালকের জন্যও রয়েছে আলাদা পুরষ্কার। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক যাঁরা হবেন তাঁদের প্রত্যেকেই ১০ হাজার টাকা করে পুরষ্কার পাবেন।
এক টানা নাটক দেখতে দেখতে যাতে দর্শকেরা বিরক্ত না হন সে জন্য রয়েছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও। সে অনুষ্ঠানে যেমন রয়েছে বাঁশির সুর, তেমনি ছৌ নৃত্যও। এদিনের অনুষ্ঠানে জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি, জেলা সভাধিপতি উত্তরা সিংহ, অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সুশান্ত চক্রবর্তী, পাপিয়া ঘোষ রায়চৌধুরী সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। রাজ্য অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান দফতর এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নাট্যদলগুলিকে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থাও করেছে প্রশাসন। জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান আধিকারিক রাহুল নাথ বলেন, “রাজ্যস্তরের এই প্রতিযোগিতাকে সফল করতে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থাই রেখেছি।” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এই ধরনের রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতা হওয়ায় খুশী সাধারণ মানুষও। সকলে আদিবাসী ভাষা না বুঝলেও নাটক দেখতে ভিড় জমান বহু সাধারণ মানুষও। |