|
|
|
|
রাতভর পিজিতে চরকিপাক জখম শিশুর
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
কোথায় আঘাত বেশি, চিকিৎসকদের মধ্যে সে নিয়ে মতপার্থক্যের মাসুল গুনল সাত বছরের একটি শিশু। দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম ওই শিশুকে নিয়ে তার পরিবারের লোকেরা বুধবার রাতে এসএসকেএম হাসপাতালের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ঘুরে চললেন। কিন্তু কেউই তার চিকিৎসার দায় নিতে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত মাঝরাতে হাসপাতালে শিশুটির একটি শয্যা জুটল ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে ততক্ষণে তার অবস্থা বেহাল।
কেন? কারণ, শিশুটির আঘাত ছিল দেহের একাধিক জায়গায়। যে অঙ্গে আঘাত বেশি, সেই বিভাগেই ভর্তি করতে হবে এমন যুক্তিতে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিভাগই তাকে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু শিশুটির প্রাথমিক শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেনি কেউই।
এমন অভিজ্ঞতার পরে শিশুটির পরিবারের লোকেদের প্রশ্ন, সাধারণ জেলা হাসপাতালে গেলেও যে পরিচর্যাটুকু পাওয়া যায়, রাজ্যের সবচেয়ে নামী হাসপাতালে সেটুকু পেতে এত ভোগান্তি হবে কেন?
বুধবার রাতে এসএসকেএম হাসপাতালের এই ঘটনা রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার একটি অত্যন্ত জরুরি দিকে আঙুল তুলেছে। অসুস্থ কোনও ব্যক্তি হাসপাতালে এলে কোন ওয়ার্ডে তাঁকে ভর্তি করা হবে, সেই তরজায় কেন সময় পেরিয়ে যাবে? কেন রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল করে তবে তাঁকে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা হবে না? কোন ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলে কেন ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ডে ভর্তি রাখার ব্যবস্থা হবে না?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে রোগী প্রত্যাখ্যানের এমন নজির আকছার তৈরি হয় বলেই ইর্মাজেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ড তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যান্য হাসপাতালের মতো এসএসকেএমেও সেই ওয়ার্ড চালু হয়েছিল। তা হলে মল্লিকা হালদার নামে শিশুটির বরাতে গোড়াতেই তা জুটল না কেন? কেন তাকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য মাঝরাতে হস্তক্ষেপ করতে হল খোদ হাসপাতালের অধিকর্তাকে? এর উত্তর স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে মেলেনি।
এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে এর জন্য পূর্ণাঙ্গ ট্রমা সেন্টার না থাকার কারণকেই সামনে এনেছেন। তাঁর মতে, পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্য ট্রমা সেন্টার যত দিন না চালু হবে, তত দিন এমন সমস্যা চলতেই থাকবে।
কী হয়েছিল বুধবার রাতে? হাওড়ার মন্দিরবাজার এলাকায় একটি পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিল সাত বছরের মল্লিকা। মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। বুকের পাঁজরে অসহ্য যন্ত্রণা। নাকের একটা পাশ থেঁতলে গিয়ে সেখান থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। আঘাত লেগেছিল চোয়ালেও। নিউরোসার্জারির চিকিৎসকেরা তাকে দেখে জানিয়ে দেন, এটা ‘নিউরো-ইমার্জেন্সি কেস’ নয়। বরং বুকে যখন আঘাত লেগেছে, তখন কার্ডিওথোরাসিকে নিয়ে যাওয়া হোক। কার্ডিওথোরাসিকের চিকিৎসেকরা পরীক্ষা করে জানান, বুকে আঘাত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আঘাত নাকে এবং চোয়ালে। তাই ইএনটি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা। ইএনটি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, নাকে আঘাত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আঘাত চোয়ালে। চোয়ালের হাড় ভেঙেছে। তাই তাঁদের কিছু করার নেই। পরের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে আউটডোরে শিশুটিকে নিয়ে আসার জন্য বাড়ির লোকজনকে পরামর্শ দেন তাঁরা।
এর পরে মাঝরাতে ইমার্জেন্সির সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। খবর যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে কার্যত পিংপং বলের মতো পাঠানোর পরে অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের নির্দেশে এক প্রকার জোর করেই কার্ডিওথোরাসিক বিভাগে ভর্তি করা হয় মল্লিকাকে।
যাঁরা অধিকর্তা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না, তাঁদের তা হলে কী হয়? প্রদীপবাবুর বক্তব্য, একাধিক অঙ্গে আঘাত থাকলে নিউরো সার্জারির অধীনে রোগীকে ভর্তি করার কথা নয়। কার্ডিওথোরাসিক বা ইএনটি-র ক্ষেত্রেও ওটা ইমার্জেন্সি কেস ছিল না। তিনি বলেন, “উচিত ছিল সার্জারি বা অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসকদের দিয়ে দেখিয়ে ওই দু’টি ওয়ার্ডের কোনও একটিতে মেয়েটিকে ভর্তির ব্যবস্থা করা। কিংবা সেখানে শয্যা না থাকলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের অধীনে ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ডে রাখা। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণেই সেটা করা যায়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।”
সমন্বয়ের অভাবের জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এর কোনও উত্তর অধিকর্তার কাছে পাওয়া যায়নি। |
|
|
|
|
|