মায়ানমারের মন পেতে ভরসা বাংলা সাহিত্যেই
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
দশ বছরেরও কম সময়ে পরপর তিন বার রেঙ্গুন সফর করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে ওই তিন বার যে বাড়িটিতে উঠেছিলেন, সেখানে স্মৃতিফলকটি এখনও অমলিন।
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র কেরানির চাকরি নিয়ে ১৯০৩ সালে পাড়ি দিয়েছিলেন রেঙ্গুন। হিসাব নিরীক্ষণের সরকারি দফতরে চাকরি করতেন তিনি। অফিসবাড়িটা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবন। সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম ঘাঁটি, তা-ও রেঙ্গুনই।
বাঙালির বর্মা (মায়ানমারের সাবেক নাম) যাত্রা সে সময় এতই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল যে, রেঙ্গুনের (এখন ইয়াঙ্গন) আস্ত একটা রাস্তার নাম হয়ে গিয়েছিল ক্যালকাটা স্ট্রিট। রাস্তাটা আজও সেই নামেই আছে।
স্বাভাবিক ভাবেই ভারত-মায়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন রাস্তা গড়তে এখন আবার বেছে নিতে হচ্ছে কলকাতাকেই। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির আদানপ্রদানই হয়ে উঠতে চলেছে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির নয়া হাতিয়ার। ইয়াঙ্গনে ভারতের রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “মায়ানমারের সঙ্গে সামগ্রিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে চায় নয়াদিল্লি। এ ক্ষেত্রে কলকাতাই একমাত্র স্থান যার সঙ্গে মায়ানমারের দীর্ঘ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগ রয়েছে। কলকাতাই হবে ভারত-মায়ানমার সম্পর্কের গেটওয়ে।” |
|
রেঙ্গুনের বিখ্যাত ক্যালকাটা স্ট্রিট। —নিজস্ব চিত্র |
বিশ শতকের গোড়াতেও ভারত-মায়ানমার সম্পর্কে যথেষ্ট টানাপোড়েন ছিল। তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। ১৯৩৭ সালে ভারতের শাসনব্যবস্থা থেকে মায়ানমারকে আলাদাও করে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়কে কেন্দ্র করে কয়েকশো বছরের পুরনো সম্পর্ক শুধুমাত্র প্রশাসনিক বিভাজনে শেষ হয়ে যায়নি। এখনকার মায়ানমারের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক খুব মধুর, এমন দাবি করেন না কেউ। কিন্তু ‘পুবে তাকাও’ নীতির সার্থক রূপায়ণের জন্য বিদেশ মন্ত্রকের কাছে মায়ানমার এক অপরিহার্য পাখির চোখ। সে ক্ষেত্রে দু’দেশের পারস্পরিক বিনিময় বাড়াতে বিদেশ মন্ত্রকের ভরসা সেই রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রই। ক’দিনের মধ্যেই মন্ত্রকের পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগ ভারত-মায়ানমার সম্পর্ক মেরামতি, সাংস্কৃতিক বিনিময়, বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানা দিক নিয়ে দু’দিন ব্যাপী আলোচনা শুরু করছে। তাতে এ দেশের ‘সফট পাওয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকর্মকেই। শরৎচন্দ্রের ‘ছবি’ গল্পটি বর্মি ভাষায় অনুবাদ করার প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। |
|
স্মৃতিফলক। রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে ছিলেন। |
মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ৮-৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতাতেই বসছে ভারত-মায়ানমার কূটনৈতিক চর্চার আসর। আলোচনায় অংশ নেবেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ইবোবি সিংহ-সহ দেশের বর্তমান ও প্রাক্তন সাত জন রাষ্ট্রদূত এবং দুই বিদেশসচিব। থাকবেন মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীও। মন্ত্রক সূত্রের খবর: ‘ভারতবন্ধু’ হিসাবে পরিচিত মায়ানমারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান খি মো নো, আউং সাং সু চি-র ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির নেতা তথা সামরিক শাসনে ২০ বছর কারাবাসে থাকা বো বো ও-র মতো ব্যক্তিত্বরাও এতে সামিল হচ্ছেন।
এ বছরই সু চি-কে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উপাধি নিতে আসার অনুমতি দেয়নি মায়ানমার সরকার। সেই পর্বের বিবাদ কাটিয়ে কলকাতায় মায়ানমারের কনসাল জেনারেল ইউ কিয়াও সে টিন্ট অনুষ্ঠানে থাকবেন। বেশ কয়েক জন সরকারি প্রতিনিধি ইয়াঙ্গন থেকেও আসছেন। পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগের হয়ে এই কূটনৈতিক চর্চার আয়োজন করছে কলকাতার ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ। সংস্থার সম্পাদক অরিন্দম মুখোপাধ্যায় বলেন, “রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে পুরনো বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তাজনিত সম্পর্ক এরই অনুসারী হবে।” |
|