|
|
|
|
বাড়িতে চড়াও হয়ে গণধর্ষণ, ব্লেডের আঘাত, এ বার আমতা
নুরুল আবসার • আমতা |
ট্রান্সফর্মারের সুইচ নিভিয়ে গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই অবসরে বাড়িতে ঢুকে দুই গৃহবধূকে শুধু গণধর্ষণ করাই নয়, ব্লেড দিয়ে তাঁদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করল মদ্যপ দুষ্কৃতীরা। এমনকী, তাঁদের যৌনাঙ্গেও ব্লেডজাতীয় ধারালো অস্ত্রের ক্ষতচিহ্ন মিলেছে।
মঙ্গলবার রাতে হাওড়ার আমতায় মুক্তিরচক গ্রামের ঘটনা। রাজনৈতিক বিবাদের জেরেই এমনটা ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের দাবি। ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ এনেছেন গ্রামবাসীদের একাংশ এবং স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বও। প্রধান অভিযুক্ত বরুণ মাকাল এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলেই পরিচিত। সে আপাতত পলাতক। তবে তার সাত জন সঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকিদের খোঁজ চলছে।
পলাতক
বরুণ মাকাল। |
বুধবার ধৃতদের উলুবেড়িয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে তোলার পরে ১০ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এদের নাম শঙ্কর মাকাল, ঝন্টু মণ্ডল, গৌরহরি মাকাল, শ্রীকান্ত পাত্র, বংশী গায়েন, গৌতম মাকাল এবং নব গায়েন। প্রত্যেকে মুক্তিরচক গ্রামেরই বাসিন্দা। ধর্ষিতা দুই মহিলা উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বুধবার চার সদস্যের একটি চিকিৎসক দল তাঁদের ডাক্তারি পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রাথমিক প্রমাণও মিলেছে বলে পুলিশি সূত্রের খবর।
পুলিশের একাংশ জানাচ্ছেন, বিবাদের ইতিহাস পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকেই শুরু। আমতা গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করলেও মুক্তিরচক এলাকা থেকে দু’জন সিপিএম-সমর্থিত নির্দল প্রার্থী জিতে যান। অভিযুক্ত বরুণ তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে ভোটে হারে। গত ১৭ ডিসেম্বর একটি রাস্তার কাজকে কেন্দ্র করে নির্যাতিতা বধূর স্বামীর সঙ্গে বরুণের মারামারি হয়। বরুণকে মারধরের দায়ে বধূর স্বামীকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। দিন পনেরো আগে জামিন পান তিনি। কিন্তু ঘরে ফিরতে পারেননি। মাঝেমধ্যে লুকিয়েচুরিয়ে বাড়ি আসতেন। তাঁর খোঁজেই বরুণরা মঙ্গলবার রাতে ওই বাড়িতে চড়াও হয় বলে পুলিশের ধারণা। ধৃতরা জেরায় কবুল করেছে, বরুণের প্ররোচনাতেই তারা হামলা চালিয়েছিল।
নির্যাতিত পরিবারটির বাড়ি খাল পাড়ে, রাস্তার ধারে। তিনটি পাকা গাঁথনির ঘর, টালির চাল। একটি ইটের পাঁচিলও রয়েছে, তবে তার পাল্লা টিনের। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার সারা দিন সরস্বতী পুজোর খাটাখাটনির পরে দু’বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে ঘরে শুয়েছিলেন বধূ (২৮)। সঙ্গে তাঁর শাশুড়িও ছিলেন। পাশের ঘরে শুয়েছিলেন বধূর জেঠশাশুড়ি (৪০)। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ১০-১২ জন দুষ্কৃতী মত্ত অবস্থায় টিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে।
পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে পরিবারটি জানিয়েছে, দুষ্কৃতীরা বারান্দার হারিকেনটি আছাড় মেরে ভাঙে। শব্দ শুনে বধূর জেঠশাশুড়ি নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেই কয়েক জন দুষ্কৃতী তাদের গলার মাফলার দিয়ে তাঁর হাত পা এবং মুখ বেঁধে ফেলে। ঘরের ভিতরে ঢুকে আসবাবপত্র তছনছ করে। এর পরে কয়েক জন তাঁকে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। বাকিরা পাশের ঘরের দরজা লাথি মেরে ভাঙে। শিশুকন্যাটি কেঁদে উঠলে ওরা তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় উঠোনে। তার পরে বধূকে উঠোনে টেনে নিয়ে গিয়ে চার-পাঁচ জন মিলে ধর্ষণ করে। কোনও রকমে ফাঁক গলে পালান বধূর শাশুড়ি। তিনিই প্রায় এক কিলোমিটার ছুটে গিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেন। তাঁর কথায়, “আমার জা এবং বৌমাকে ওরা যখন নির্যাতন করছিল, তখনই আমি কোনও মতে ছুটে বেরোই। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে করতে ফাঁড়িতে ছুটে যাই।” |
আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অভিযুক্তদের। |
ট্রান্সফর্মারের সুইচ নিভিয়ে দেওয়ায় এমনিতেই গোটা এলাকা অন্ধকার ছিল। তার উপরে আশপাশের বাড়িগুলিও ছিল পুরুষশূন্য। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক বিবাদের জেরেই পাঁচ-ছটি পরিবারের পুরুষরা দীর্ঘদিন ঘরছাড়া হয়ে রয়েছেন। ফলে সে দিন রাতে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব টের পেয়েও ভয়ে এগিয়ে আসতে পারেননি অন্য বাড়ির মহিলারা। ফাঁড়ি থেকে খবর যায় আমতা থানায়। বিশাল পুলিশবাহিনী এসে গ্রাম থেকেই প্রথমে দু’জন দুষ্কৃতীকে ধরে। তাদের জেরা করেই রাতেই আশপাশের গ্রাম থেকে বাকিদের ধরা হয়।
সিপিএম জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার এ দিন বলেন, “আমাদের বহু সমর্থক ঘরছাড়া। পরিবারের মহিলারা অরক্ষিত। যারা এখনও সিপিএম সমর্থক রয়েছেন, তাঁদের ভয় দেখাতে ওই মহিলাদের উপর অত্যাচার চলছে।” এ দিন আমতা থানায় স্মারকলিপি জমা দিয়ে ঘরছাড়া পুরুষদের ফেরানোর দাবি এবং পরিবারগুলির নিরাপত্তার দাবি জানায় সিপিএম। এ দিন ব্রিগেডে বিজেপি-র সভায় দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন।
উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি বিশ্বনাথ লাহা অবশ্য দাবি করছেন, বরুণ মাকালকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই ঘটনায় জড়ানো হয়েছে। তবে তিনি এ-ও বলছেন, “বরুণ দোষী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি হোক। অভিযুক্তরা যে দলেরই হোক, আইন যেন তার নিজের পথে চলে।” রাজ্যের মন্ত্রী এবং জেলার তৃণমূল নেতা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “এটা কোনও দলের বিষয় নয়। পুলিশি তদন্তে যে দোষী প্রমাণিত হবে, তারই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।”
ঘটনার জেরে এ দিন বেলা পর্যন্ত এলাকার দোকানপাট বন্ধ ছিল। দুপুরে আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) সঞ্জয় সিংহ, ডিআইজি (পিআর) আনন্দকুমার-সহ হাওড়া জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তারা গ্রামে যান। সঞ্জয়বাবু জানান, বাড়িটিকে দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ফরেন্সিক দলকেও খবর দেওয়া হয়েছে। |
ছবি: সুব্রত জানা। |
|
|
|
|
|