|
|
|
|
কংগ্রেস-বামকে তোপ, নরম সুর মমতার প্রতি
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দু’হাতে তিন লাড্ডু!
একেবারে তাঁর নিজস্ব লব্জে রাজ্য ও কেন্দ্রে সহাবস্থানের এক তত্ত্ব হাজির করে রাজ্য রাজনীতির রসায়নে নতুন চর্চার ইন্ধন দিয়ে গেলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী! গোড়ায় দুই লাড্ডুর কথাই বলেন। রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর কেন্দ্রে তিনি। শেষ পর্বে এসে সঙ্গে জুড়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নামও।
এর মাঝেই কংগ্রেস ও তৃতীয় ফ্রন্টকে প্রবল আক্রমণ করলেন। কিন্তু সরাসরি তৃণমূলের উদ্দেশে কিছু বললেন না। বরং গোড়ায় পরিবর্তনের সুফল পাওয়া নিয়ে যে প্রশ্ন ময়দানে হাজির জনতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আনলেন সহাবস্থানের তত্ত্ব। বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মতো করে রাজ্যে উন্নয়নের কাজ করুন। আর কেন্দ্রে তাঁকে (মোদীকে) সরকার গড়তে দেওয়া হলে তিনিও বাংলার উন্নয়নেই সচেষ্ট হবেন। আর মাথার উপরে ‘প্রণবদা’ তো আছেনই!
রাজ্য রাজনীতির অনেকেই এই কথা শুনে বলছেন, এই লাড্ডুর স্বাদ কি তৃণমূলের আদৌ মিষ্টি লাগবে! সংখ্যালঘুদের সমর্থন না-থাকলে গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে জয়যাত্রা যে সম্ভব হতো না, সেটা তৃণমূল নেতৃত্ব ভালই জানেন। তাই এ বারে বিজেপি-র সঙ্গ নিয়ে সেই সমর্থন খোয়াতে চান না তাঁরা। ভরা ব্রিগেডে মোদীর হাত থেকে পাওয়া সেই লাড্ডু তাই তাঁদের কাছে তেতো লাগাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে এই লাড্ডু-তত্ত্বের পরেই যখন দুই দলের মধ্যে গোপন আঁতাঁতের অভিযোগ এনেছে বিরোধীরা। মোদীকে সরাসরি আক্রমণ না করলেও বিরোধীদের সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, “আমাদের কারও সার্টিফিকেট দরকার নেই!” |
জনসভায় নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা। বুধবার ব্রিগেডে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
কিন্তু এটাই কি চেয়েছিলেন রাজ্য বিজেপির নেতারা? তাঁরা বরং চেয়েছিলেন, লোকসভা ভোটের আগে কলকাতায় এসে তৃণমূলের সম্পর্কে কড়া অবস্থান নিন মোদী। এমন কিছু বার্তা দিন, যাতে এ রাজ্যে সংগঠন তৈরির কাজে তাদের সুবিধা হয়। এ দিন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ তাঁর বক্তৃতায় সেই সুরই বেঁধে দেন। বলেন, “কেউ কেউ বলছেন, আবার কি তৃণমূলের সঙ্গে জোট হবে? আমরা বলছি, ন্যাড়া বেলতলায় বারবার যাবে না! আমরা ১০ বছর ঘর করেছি! আর ওই পথে যাব না!” তাঁর মতোই একই ভাবে তৃণমূলকে আক্রমণ করেন রাজ্য বিজেপি-র সংখ্যালঘু শাখার নেতা শাকিল আনসারি, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, শাহনওয়াজ হুসেনের মতো রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের জন্য রাজ্য সরকারের ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তকে তাঁরা কী ভাবে আদালতে গিয়ে আটকেছেন, সেই কথার পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে এ দিন আমতার ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন রাহুলবাবু। তাঁদের বক্তৃতায় হাততালিও পড়ল মুহুর্মুহু।
কিন্তু বুধবার ব্রিগেড ময়দানে দাঁড়িয়ে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী সে পথে গেলেন না। এ রাজ্যে সত্যিই কি পরিবর্তন এসেছে গোড়ায় তাঁর এই প্রশ্ন শুনে জনতার সমবেত জবাব ছিল, ‘না!’ এর পরে বাকি বক্তৃতায় তৃণমূল নেত্রীর উদ্দেশে তোপ না দেগে মোদী বরং বলেন, আসল পরিবর্তনের লাড্ডুর স্বাদ পেতে হলে কেন্দ্রে কংগ্রেস নয়, তাঁকে আনুক মানুষ। সেই সূত্রেই তাঁর রাজনৈতিক সহাবস্থানের তত্ত্ব “বাংলায় পরিবর্তনের সরকার এনেছেন আপনারা। তাদের কাছে হিসেব চাইবেন। দিল্লিতে মোদীর সরকার আনুন। তারাও উন্নয়নের কাজ করবে। প্রতিযোগিতা হলে বাংলার ভালই হবে। আপনাদের দু’হাতেই লাড্ডু থাকবে!”
তবে মোদী যেমন কৌশলে মমতার বিশেষ বিপক্ষে বলেননি, আবার পক্ষেও বলেননি। কিন্তু বিজেপি-র সভাপতি রাজনাথ সিংহ এক ধাপ এগিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের কাছে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিন বছর ঋণের সুদ মকুবের (মোরাটরিয়াম) যে দাবি জানিয়ে আসছেন, তাকে জোর গলায় সমর্থন করেছেন। বিজেপি সভাপতি বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের ঋণ ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা! সিপিএম বাংলার কোষাগারকে ফোঁপরা করে দিয়ে গিয়েছে! কেন্দ্রের উচিত, পশ্চিমবঙ্গের ঋণের উপরে সুদ স্থগিত রাখা।” তৃণমূল সরকার নয়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কথা ভেবেই কেন্দ্রের ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন রাজনাথ। |
উড়ছে বিজেপি-র পতাকা। বুধবার ব্রিগেডে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী। |
ব্রিগেডে বিজেপি-র দুই শীর্ষ নেতার এ দিনের বক্তব্যের পরেই সরব হয়েছে বাম এবং কংগ্রেস। আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “ভোটের পরে মোদী তৃণমূলের জন্য রাস্তা খোলা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হল। সেটাই ওঁদের লক্ষ্য। তাই তৃণমূলকে সমালোচনা করেননি তিনি।” এ রাজ্যের জ্বলন্ত সমস্যা নারী নির্যাতন নিয়ে মোদী কেন কোনও মন্তব্য করেননি, সেই কটাক্ষও করেছেন বিমানবাবু। কংগ্রেসের তরফে মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “মোদী তো বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখে গেলেন! তৃণমূল নেতৃত্ব এ বার স্পষ্ট করে বলুন, তাঁরা কী করবেন!”
কৌশলগত ভাবে মোদীকে কড়া আক্রমণ না করলেও বিরোধীদের এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেছেন, “বাংলা নিজের দাবিতে লড়াই করবে। বাংলার সেই স্বাভিমান আছে! আর সে কারণেই বাংলার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার আত্মসম্মান ফিরিয়ে আনা এবং বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দিল্লি চলোর ডাক দিয়েছেন।” পাশাপাশি বিমানবাবুদের আক্রমণ করে তাঁর কটাক্ষ, “পাগলে কী না বলে!”
প্রশ্ন হচ্ছে, রাহুল সিংহ রাজ্য বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতে যা বললেন, মোদী বা রাজনাথ তা এড়িয়ে গেলেন কেন?
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সূত্রে বলা হচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগে প্রচারে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছেশীর্ষ নেতাদের। এক দিকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে। তাই মোদী-রাজনাথরা পরিবর্তনের সুফলের প্রসঙ্গ তুলেছেন। আবার সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটও অস্বীকার করা অসম্ভব তাঁদের পক্ষে। রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখে তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে যে এখনই এনডিএ-তে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, বিজেপি নেতৃত্বের তা জানা। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে তাঁরা কোনও সম্ভাবনাই নষ্ট করতে চাইছেন না। এমন পরিস্থিতিতে সরাসরি মমতার প্রতি বন্ধুত্বের কথা বলতে গেলে রাজ্যে বিজেপি-র অসুবিধা প্রকট হয়ে যেত। কারণ, মমতার ক্ষতি হলে এই রাজ্যে লাভ তুলবে কংগ্রেস এবং বাম, যারা কোনও ভাবেই ভোটের পরে বিজেপির সঙ্গ দেবে না।
তাই সব দিক মাথায় রেখেই মোদী-রাজনাথেরা এমন কৌশলী বার্তা দিয়েছেন, যাতে ভোট পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য কোনও দরজাই একেবারে বন্ধ না হয়। তাই প্রাথমিক তালিকায় থাকলেও কট্টর তৃণমূল-বিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত বরুণ গাঁধীকে বক্তৃতায় ডাকা হয়নি। বরং মোদী কৌশলে বলেন, “মমতাজি তাঁর মতো করে রাজ্যে কাজ করবেন। কেন্দ্রে আমাদের আনলে আমিও উন্নয়ন করব। আর দিল্লিতে আমাদের উপরে আছেন প্রণবদাদা! তিনি তো আপনাদেরই লোক! তিন জনে মিলে সোনার ভারত গড়ব।” |
নরেন্দ্র উবাচ |
• বাংলায় পরিবর্তনের সরকার এনেছেন। তাদের কাছে হিসেব চাইবেন। দিল্লিতে মোদীর সরকার আনুন। তারাও উন্নয়নের কাজ করবে। প্রতিযোগিতা হলে বাংলার ভালই হবে। আপনাদের দু’হাতেই লাড্ডু থাকবে!
• মমতাজি তাঁর মতো করে কাজ করবেন। কেন্দ্রে আমাদের আনলে আমিও উন্নয়ন করব। আর দিল্লিতে আমাদের উপরে আছেন প্রণবদাদা! তিনি তো আপনাদেরই লোক! তিন জনে মিলে সোনার ভারত গড়ব।
• পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্য তো শুধু রাজ্য সরকারকে দিয়ে বদলানো যাবে না। কেন্দ্রেও আপনাদের সরকার থাকতে হবে। |
|
বাংলাকে মজাতে আরও অস্ত্র ছিল মোদীর। বক্তৃতা শুরু করেন বাংলায়। গুজরাতি উচ্চারণে কখনও বলেন, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি!” কখনও আওড়ান, “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য...।” ঘটনাচক্রে, যা তৃণমূল নেত্রীরও প্রিয় লাইন! রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-সহ বাঙালি ব্যক্তিত্বদের নাম করে আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শেষে বলেন, “সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। আমি বলে যাচ্ছি, তোমরা আমাকে সাথ দাও, আমি তোমাদের সুরাজ (সুশাসন) দেব!”
সমাবেশ শেষে বিজেপি-র এক নেতার প্রতিক্রিয়া, “ধুরন্ধর রাজনীতিকের মতো যা বলার, বলে গেলেন মোদী! তাঁর কথার অর্থ এ বার যে যার মতো করবে!” |
|
|
|
|
|