বনগাঁ হাসপাতালের ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডে ঢুকে কাছে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন বছর পঁয়তাল্লিশের বেলি বিশ্বাস। এক্সট্রা ৩ নম্বর বেডে বসে খাটে বসে পা দোলাচ্ছিলেন। বলে উঠলেন, “বাড়ি যাব।” কিন্তু বাড়ি কোথায়? জানেন না তিনি। জানেন না হাসপাতালের নার্স, আয়া থেকে সুপারও। তাই গত পাঁচ মাস ধরে হাসপাতালই বাড়ি হয়ে উঠেছে তাঁর। খোঁজ পাওয়া যায়নি বাড়ির লোকের। খোঁজ করতেও আসেননি কেউ।
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বনগাঁ হাসপাতালই ঠিকানা বেলি বিশ্বাসের। ওই ওয়ার্ডেই প্রায় আড়াই বছর ধরে রয়েছেন অঞ্জলি শিকদারও। তাঁরও বাড়ির খোঁজ নেই। তবে তাঁর গল্প আলাদা। বাংলাদেশ থেকে এসে এখানেই কোনও ডাক্তারের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন বলে মনে পড়ে তাঁর। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দু’জনের গল্পে পার্থক্য রয়েছে অনেক। কিন্তু মিল একটাই। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রাণে বাঁচলেও স্মৃতি প্রায় নেই। কেউ খোঁজ করতেও আসেননি ওঁদের। তাই দু’জনেই থেকে গিয়েছেন হাসপাতালে। খাবার আর ওষুধের খরচও দেয় হাসপাতাল। আর জামাকাপড় দেন নার্স বা আয়ারা। মায়া পড়ে গিয়েছে ওঁদের। কাছাকাছি কোনও মেয়েদের হোম না থাকায় কোথায় ওঁদের রাখা যায়, সে ব্যাপারেও কোনও সঠিক দিশা নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। আপাতত কোনও হোমে ওঁদের রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা, জানালেন হাসপাতাল সুপার গয়ারাম নস্কর। বললেন, “দু’টো বেড ওঁদের জন্য আটকে থাকলেও মানবিক কারণেই ওঁদের এখানে রাখা হয়েছে।” |
হাসপাতালের খাতায় বেলি বিশ্বাসের এখনও কোনও নাম নেই। তিনি এখনও অজ্ঞাতপরিচয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে রেল দুর্ঘটনায় গুরুতর চোট পান তিনি। দু’কান দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। রেলপুলিশ তাঁকে এখানে ভর্তি করে দিয়ে যায়। বাঁচবেন, ভাবতে পারেননি কেউ। কিন্তু চিকিৎসক, নার্সদের চেষ্টায় প্রাণে বাঁচলেও স্মৃতির অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায় তাঁর। চিকিৎসকদের বক্তব্য, ‘ইন্টারনাল ইনজ্যুরি’র কারণেই স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায় তাঁর। কথাবার্তাও অসংলগ্ন। হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে যে নার্স ও আয়ারা কর্মরত, তাঁরাই ডাকার সুবিধার জন্য ওঁর নাম রেখেছেন বেলি। হাসপাতালের বেডে বসে বেলি বললেন, বাড়ি যেতে চান তিনি। কিন্তু বাড়ি কোথায়? একবার বললেন চন্দননগর। পরের বার বললেন পাটিকাবাড়ি। তবে স্বামী আর ছেলের নাম আবছা মনে পড়ে তাঁর। জানালেন, স্বামী আশুতোষ বিশ্বাস দরজির কাজ করতেন। ছোট ছেলের নাম বললেন ঋষপ। কিন্তু হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, এইরকম কারওর খোঁজ পাননি তাঁরা। কেউ তাঁর খোঁজ করেও আসেননি হাসপাতালে। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন এক নার্স। বললেন, “শুধু বাড়ি যেতে চায়। কিন্তু কেউই তো জানে না বাড়ি কোথায়। এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু কোথায় যাবে?” হাসপাতালের আয়াদেরও বক্তব্য, “এত দিন রয়েছে। কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। চলে গেলে মন খারাপ হবে। কিন্তু সত্যিই যদি ওঁর পরিবারের লোকেরা ওঁকে নিয়ে যান, ওঁর ভাল লাগবে।”
১৮ নম্বর বেডের অঞ্জলি অবশ্য বাড়ি ফিরতে চান না। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে হাসপাতালেই রয়েছেন বছর পঞ্চাশের ওই মহিলা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু তারপর থেকে কেউ আর কোনও খোঁজ নিতে আসেননি। স্মৃতি ঝাপসা। পড়াশোনাও জানেন কিছুটা। নাম সই করতে পারেন। বললেন, “আমি বোধ হয়, অনেকের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে অনেকের সঙ্গে এ দেশে চলে এসেছিলাম। এক ডাক্তারের বাড়িতে কাজ করতাম।”
নার্সরা জানালেন, অঞ্জলি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেলেও মৃগী রোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যায়। মাস খানেক আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে ডান পা ভেঙে গিয়েছে। এখন ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটছেন। খানিকটা সুস্থ হলেও অঞ্জলি এখনও মনে করতে পারেন না, কী ভাবে পড়ে গেলেন ছাদ থেকে। কে বা কারা তাঁকে হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, কে বা কারা অঞ্জলিকে হাসপাতালে রেখে দিয়ে গিয়েছিল, তা হাসপাতালের কেউই জানেন না। হাসপাতালের খাতাতেও কোনও তথ্য প্রমাণ নেই। তবে জ্ঞান ফিরলে নিজের নাম বলতে পেরেছিলেন অঞ্জলি। বেলি বিশ্বাসের মতো বাড়ি ফিরে যেতে চান না অঞ্জলি। বললেন, “আমার কেউ কোথাও নেই। হাসপাতালই বাড়ি। আর যাবই বা কোথায়? কাজ করার ক্ষমতা নেই। কাজে নেবে না কেউ।”
বেলি আর অঞ্জলির ভবিষ্যতের ঠাঁই কোথায় হবে, জানেন না কেউই। গয়ারামবাবু বলেন, “অনেক খোঁজ করেও এঁদের বাড়ির খোঁজ মেলেনি। পুলিশকেও জানিয়েছি। কাছাকাছি মেয়েদের থাকার মতো কোনও হোমও নেই। তবে চেষ্টা করছি, যদি ওঁদের কোনও হোমে রাখা যায়।”
জেলা সমাজ কল্যাণ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।” |