মাঝরাতে ঘরটা কেঁপে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। চোখ খুলে নারায়ণীদেবী যা দেখেছিলেন তাতে আতঙ্কে ফের বুজে গিয়েছিল তাঁর চোখ।
টিনের ঘরের দেওয়ালটা দুমড়ে গিয়েছে। আর ঘরের মধ্যে হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে মাথা দুলিয়ে চলেছে ‘মহাকাল’ (উত্তরবঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারা হাতিকে এ নামেই উল্লেখ করেন)। এক বার ওঠার চেষ্টা করে বুঝেছিলেন বিছানা নয়, মাটিতে পড়ে গিয়েছেন তিনি। তখনই খেয়াল হয়, তাঁর বছর পাঁচেকের মেয়ে স্নেহা, হাতির গুঁতোয় হেলে পড়া খাট থেকে সেও গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তারস্বরে কাঁদতে শুরু করে সে। |
মায়ের কোলে পাঁচ বছরের স্নেহা। —নিজস্ব চিত্র। |
সুবিশাল দাঁতালটি এ বার এগিয়ে আসতে থাকে তাঁদের দিকে। আধো অন্ধকার রাতেও নারায়ণী বুঝতে পারেন হাত তিনেক দূরে এসে গিয়েছে সে। আর এক পা বাড়ালেই তাঁর আদরের স্নেহা। তারপর... আতঙ্কে ফের চোখ বুজে ফেলেন তিনি। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখেন তাঁর চিল-চিৎকার করে কেঁদে ওঠা মেয়েকে শুঁড়ে জড়িয়ে আস্তে করে খাটে বসিয়ে ফিরে যাচ্ছে সেই দাঁতাল।
মঙ্গলবার রাতে শামুকতলার উত্তর পানিয়ালগুড়ি গ্রামে এমনটাই হয়েছে বলে জানাচ্ছেন নারায়ণী দেবী।
হস্তি বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এমন ‘অবিশ্বাস্য’ ঘটনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বক্সা ব্যঘ্র প্রকল্পের (পশ্চিম) ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর অপূর্ব সেন বলেন, “এমন ঘটনার কথা আগেও লোকমুখে শুনেছি। আপাতত হাতির হানা ঠেকাতে ওই গ্রামগুলিতে রাতে টহলদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠনের কর্তাদের কাছেও রয়েছে এমন অভিজ্ঞতার কাহিনী। হিমালয়ান নেচার এন্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় এমন নানা ঘটনা শোনা যায়। আগেও শুনেছি।” আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের চেয়ারম্যান অমল দত্ত বলেন, “হাতি যখন বুঝতে পারে কেউ তাকে আঘাত করছে, একমাত্র তখনই সে পাল্টা আঘাতের চেষ্টা করে। কাজেই এমনটা হতেই পারে।” নেচার হেল্প অর্গানাইজেশনের সন্দীপ সরকারের অভিজ্ঞতা বলছে, “বছর কয়েক আগে প্রায় একই ঘটনার সাক্ষী ছিলজলদাপাড়া অভয়ারণ্যের কোদালবস্তি। সেখানেও এক বৃদ্ধাকে একই ভাবে শুঁড়ে জড়িয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল এক দাঁতাল।”
ওই দিন রাতে নারায়ণীদেবীর স্বামী জীতেনবাবু বাড়ি ছিলেন না। আলিপুরদুয়ারে ডুয়ার্স উৎসবে স্টল দিয়েছেন তিনি। রাতে সেখানেই ছিলেন। বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে একাই ছিলেন ওই মহিলা।
এ দিন সকালেও তাঁর চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক। তিনি বলেন, “হাতিটা প্রথমে রান্নাঘরের চালা ভেঙে নুন খেল। তারপরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে।” হাতি চলে যাওয়ার পরেও সারা রাত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে জেগে ছিলেন নারায়ণীদেবী। এ দিন সকালেও বিড় বিড় করছেন, “এ বাড়িতে রাতে আর একা থাকব না, ঢের শিক্ষা হয়েছে।” |