তেল-ঘি বর্জন কি স্বাস্থ্যসম্মত, প্রকট প্রশ্ন
ঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন এক ছিপছিপে মানুষ। তিনি জীবনশৈলী সংক্রান্ত রোগ (লাইফস্টাইল ডিজিজ)-এর চিকিৎসা করেন। শ্রোতাদের অধিকাংশ হয় সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কিংবা অবসরের দরজায়। কেউ হাঁটু নাড়াতে পারছেন না, কারও পক্ষে কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন। কাউকে লাঠি নিয়ে চলতে হয়। অনেকেই ঘি-তেল-মাখন পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন। ডাক্তারের পরামর্শ শুনে, অথবা নিজে নিজে। বক্তার কথা শুনে ওঁরা চমকে উঠলেন!
উনি বলছেন, “আপনারা ঘি খাবেন। সর্ষের তেলও। তবে নিয়ন্ত্রিত ভাবে। দেখবেন, ভালো থাকবেন। ঘি বা সর্ষের তেলে কোনও সমস্যা হয় না।” এ যে একেবারে উল্টো তত্ত্ব!
হতচকিত শ্রোতাদের সামনে ব্যাখ্যা দিলেন বক্তা। মানে চিকিৎসক রামেন্দু হোমচৌধুরী। বললেন, “শরীরের ভিতরের তাপমাত্রায় জমে যায় না, এমন সব চর্বিজাতীয় পদার্থ খেতে বাধা নেই। তাই পরিমিত পরিমাণে ঘি বা সর্ষের তেল খেতে বলছি। তবে মাখন নয়। নারকেল তেল বা পাম তেলও নয়। কারণ ওগুলো দেহের অভ্যন্তরের তাপমাত্রায় জমে যায়। তাই ক্ষতিকারক।”
যন্ত্রণা উপশম তো বটেই, মেদ ঝরিয়ে রোগা হওয়ার তাগিদে যাঁরা খাদ্যতালিকা থেকে ঘি-তেল বাদ দিয়েছেন, তাঁদের কাছেও এটা নতুন বার্তা। এত দিন ওঁরা ভেবে এসেছেন, খাবার থেকে ফ্যাট, অর্থাৎ স্নেহপদার্থের ছোঁয়া ছেঁটে দিলেই চেহারা হবে ছিপছিপে, আকর্ষণীয়। কিন্তু আহারের এ-হেন ‘স্নেহবর্জিত’ পন্থা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি না, রামেন্দুবাবুর মতো অনেক চিকিৎসক সেই প্রশ্ন তুলছেন। শারীরবিদ, হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদ, ডায়েটেশিয়ানদের একাংশের অভিমত, তেল-ঘি পুরোপুরি বর্জনের অভ্যাস বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারও কারও দাবি: প্রক্রিয়াজাত (প্রসেস্ড) যে কোনও খাবার, এমনকী ক্যানবন্দি ফলের রসের চেয়ে টোস্টে খানিকটা মাখন অনেক কম ক্ষতিকর!
সম্প্রতি ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধও তা-ই বলছে। এক দল ভারতীয় বিজ্ঞানীর ওই গবেষণাপত্রে জানানো হয়েছে, ঘিয়ের মধ্যে এমন কিছু এনজাইম মজুত, যা কিনা ক্যানসার সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম। আবার ঘিয়ের অন্যতম উপাদান লিনোলিক অ্যাসিডও ক্যানসার-প্রতিরোধী। লিনোলিক ও লিনোলিনিক অ্যাসিডে সমৃদ্ধ হরেক ভোজ্য তেলও উপকারী। ওই তালিকায় সর্ষের তেলের পাশাপাশি ঠাঁই করে নিয়েছে সূর্যমুখী, তিল বা তুষের তেল।
অর্থাৎ রোজকার মেনু থেকে স্নেহপদার্থকে সম্পূর্ণ বিদায় দেওয়াটা কাজের কথা নয়। এতে স্বাস্থ্যের চাহিদা অপূর্ণ থেকে যাবে বলেই দাবি করছেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের অনেকে। শারীরবিদ্যার অধ্যাপক তুষার ঘোষ যেমন বলছেন, “প্রতিদিন শরীরে যত ক্যালরি প্রয়োজন, তার ১৫%-২০% ফ্যাট থেকে নিতে হয়। তাই জরুরি ফ্যাট না-খেলে দেহের চাহিদা পূরণ হয় না। তেল-ঘি থেকেই প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।” কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসুর দাবি, “হার্টের সমস্যার জন্য আগে অনেকে ঘি-কে দায়ী করতেন! অযৌক্তিক! ঘি এইচডিএল, অর্থাৎ ভাল কোলেস্টরল বাড়ায়। যা হার্টের পক্ষে খুবই দরকারি।”
ডায়েটিশিয়ান রেশমী রায়চৌধুরীর অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্য-সচেতনতা ছাপিয়ে এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌন্দর্য সচেতনতা। তাই খাদ্যতালিকা থেকে ফ্যাট পুরো বাদ যাচ্ছে। “যাঁরা নিজেদের সৌন্দর্য সম্পর্কে বেশি সচেতন, তাঁদের বলি, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে, চুল চকচকে ও মজবুত করতে কিংবা হাড়ের ব্যথা কমাতেও কিন্তু ফ্যাট দরকার। স্রেফ সেদ্ধ খেয়ে গেলে শরীরে অনেক ঘাটতি তৈরি হবে।” মন্তব্য রেশমীদেবীর। ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া ও তেল-ঘি সম্পূর্ণ বর্জনকে সমর্থন করছে না। লিনোলিক ও লিনোলিনিক অ্যাসিড থাকা বিভিন্ন রান্নার তেলকেও তুলনায় নিরাপদ বলে তারা মনে করে। ডাক্তারেরা ইদানীং বলছেন, মাছের তেলও হার্টের পক্ষে উপকারী।
এর মানে কিন্তু যথেচ্ছ ঘি-তেল সেবন নয়, মনে করিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎবাবু। ওঁর দাওয়াই, “ঘি থাকুক খাদ্যতালিকায়। তবে ফ্যাটের মোট পরিমাণ যেন না-বাড়ে। সপ্তাহে দু’-এক চামচ ঘি দিব্যি খাওয়া চলে।” কার্ডিওলজিস্ট শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি, “মোট যতটা ফ্যাট প্রয়োজন, তার বেশি যেন না-যায়।” পুষ্টিবিদ সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ঘোষের পরামর্শ, “২৫ বছর বয়স পর্যন্ত দিনে দু’চামচ ঘি খাওয়া যেতে পারে। ৩৫ পর্যন্ত এক থেকে দু’চামচ। তার পরে দিনে এক চামচ। হার্টের সমস্যা বা মোটা হওয়ার প্রবণতা থাকলে রোজ খাওয়া উচিত নয়।” তাঁর হিসেবে, শরীরে দৈনিক যত ক্যালরি প্রয়োজন, তার ২০%-৩০% আসা উচিত ফ্যাট থেকে। আর তার ১০% হতে হবে স্যাচুরেটেড। মানে ঘি বা তেল। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদেরা জানাচ্ছেন, শরীরের আসল শত্রু ট্রান্স ফ্যাট। সেটা কী?
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা: ট্রান্স ফ্যাট হল এক ধরনের আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা যায়। ব্যবহার হয় মূলত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে। ট্রান্স ফ্যাট শরীরে লাইপোপ্রোটিন অর্থাৎ কোলেস্টরল বাড়ায়। তাতে হার্টে গণ্ডগোল দেখা দিতে পারে। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের মতে, এক প্যাকেট ফলের রস খাওয়ার চেয়ে রান্নায় তেল বা ভাতের সঙ্গে ঘি ভাল। কেননা প্যাকেটজাত ফলের রসে আছে অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট। শুধু ফলের রস নয়। প্রসেস করা, প্যাকেটজাত বহু খাদ্য-পানীয়ে ট্রান্স ফ্যাট ভাল মাত্রায় হাজির।
ডাক্তারদের পরামর্শ, ‘‘প্যাকেজড ফুড খাওয়ার আগে জেনে নিন, তাতে কত শতাংশ ট্রান্স ফ্যাট। প্যাকেট বা ক্যানের পিছনে এর উল্লেখ থাকার কথা।’’ একই যুক্তিতে রাস্তার দোকানের মুখরোচক তেলেভাজা সম্পর্কেও সতর্ক-বার্তা থাকছে। কারণ, একই তেল বার বার ব্যবহার করা হলে সেই ভাজার মধ্যে প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট জমা হয়। “সুতরাং কোনটা খারাপ ফ্যাট আর কোনটা ভাল, তা চিনতে হবে। ভাল ফ্যাট খান। অবশ্যই বুঝে-শুনে, মাত্রা রেখে। তাতে ভালই হবে।” মন্তব্য এক পুষ্টিবিদের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.