একদিকে মহানন্দা অভয়ারণ্যের জঙ্গল। পাশে ছোট্ট গুলমা রেল স্টেশন। মাঝ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে মহানন্দা এবং গুলমা খোলা নদী। দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পাহাড়। প্রায়ই পাশের জঙ্গলে হাতি, চিতাবাঘের সঙ্গে দেখা মেলে নানা পাখি, কীটপতঙ্গ-সহ নানা বন্যজন্তু। নিস্তব্ধ, শান্ত এই পরিবেশে সময় কোথা দিয়ে চলে যায় তা টের পাওয়াই দায়। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ শিলিগুড়ি লাগোয়া এই গুলমা এলাকায় তৈরি হতে চলছে পর্যটনের নতুন ঠিকানা। রাজ্য সরকারের বন দফতরের নতুন রিসর্ট। অনেকটা ডুয়ার্সের ধূপঝোরা গাছবাড়ির আদলে।
সরকারি সূত্রের খবর, ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে উত্তরবঙ্গ সফরে এসে বেশ কয়েকবার সুকনা বন বাংলোয় রাত কাটিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গত মাসের শেষেও দার্জিলিং সফরের পর কলকাতা ফেরার আগের রাতে মুখ্যমন্ত্রী সুকনায় ছিলেন। তিনি লাগোয়া গুলমা এলাকায় ওই রিসর্ট বা সরকারি বাংলোর তৈরির কাজে দ্রুত নামতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব’কে নির্দেশ দেন। গত সোমবারই কলকাতায় মন্ত্রী বন দফতরের অফিসারের সঙ্গে বৈঠক করে প্রকল্পের কাজে হাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। |
গৌতমবাবু বলেন, “মহানন্দা অভয়ারণ্যের ওই এলাকা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পাহাড়, নদী, জঙ্গল, রেল স্টেশন কী নেই ওখানে। মুখ্যমন্ত্রী চান, যত দ্রুত সম্ভব এলাকাটিকে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে নিয়ে আসতে। সেই কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রয়োজনী পুরো টাকাই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর খরচ করবে। বন দফতর ওই কাজ করবে। বন দফতরের অফিসারদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে।” বন দফতরের রাজ্যের মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ-উত্তর) বিপিন সুদ শুধু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী চান এলাকায় রাজ্যের একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়া হোক। সেই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ওই এলাকায় বেশির ভাগ জমিই বন দফতরের অধীন মহানন্দা অভয়ারণ্যের। সরকারি নিয়ম অনুসারে ওই জমিতে কোনও পর্যটন কেন্দ্র বা রিসর্ট করা সম্ভব নয়। কিন্তু জঙ্গল লাগোয়া এলাকাটিকে খয়রানিবস্তি, পুনডিং এবং খয়েরজোড়ার মত কয়েকটি বনবস্তি রয়েছে। সেখানে প্রচুর সরকারি জমি রয়েছে। যে এলাকাটিকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে ৫ একর জমি রয়েছে। তবে জমির কিছুটা অংশ বনবস্তির মধ্যে। তাঁদের সরকারি উদ্যোগে জমির পাট্টা ওই বাসিন্দাদের হাতে রয়েছে। ইতিমধ্যে অবশ্য ঠিক হয়েছে, প্রকল্পের অধীনে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে ওই বাসিন্দাদের দিয়েই রিসর্টটি চালানো হবে।
শাল সেগুনের মত বড় গাছ ছাড়াও নানা ধরণের ফলের গাছ লাগিয়ে সাজানো হবে। ডুয়ার্সের মূর্তি রিসর্টের আদলে ১৫টি অত্যাধুনিক কটেজ তৈরি হবে। কমপক্ষে ৫টি গাছবাড়ি তৈরি হবে। সেই জন্য প্রকল্পের হাতে দেওয়ার শুরুতেই বড় গাছ এলাকায় বাছাই করে লাগিয়ে দিতে বলা হয়েছে। জৈব চাষের ব্যবস্থা করা হবে। সেখানকার শাক, সব্জি দিয়েই পর্যটকদের রসনা মেটানো হবে। থাকবে মুরগি’র ফার্মও। হাতি সাফারিও হতে পারে। ২০০৫ সাল নাগাদ সুকনা, গুলমার হাতি সাফারি চালু হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, গুলমা স্টেশন বা সুকনা বন দফতর থেকে কটেজ অবধি পর্যটকদের গরুর গাড়িতে নিয়ে আসা ও ঘোরানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। বনবস্তির বাসিন্দাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পর্যটকদের দেখাশুনো করার উপযোগী করার বিষয়টিও প্রকল্পের মধ্যে রাখা হয়েছে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ১৩ কিলোমিটারের মধ্যে মহানন্দা অভয়ারণ্য। প্রায় ১২৭ স্কোয়ার কিলোমিটারের এই অভয়ারণ্য পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা বলতে সুকনা এবং লাটপাঞ্চার বন বাংলো। দুটিতেই ‘ভিআইপি’দের আনাগোনা বেশি থাকায় পর্যটকরা সাধারণত ঘর পান না বলে অভিযোগ। সুকনা দিয়ে জঙ্গলের কিছুটা এলাকা ঘোরার পর্যটকদের কেবলমাত্র অনুমতি মেলে। অভয়ারণ্যের ৮ মাইলে পর্যটকদের ঢোকার একটি ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। লালটং, গুলমা, টোরিবাড়ি এবং গোলাঘাটে ওয়াচ-টাওয়ার থাকলেও তা বন দফতরের কর্মীরা শুধুমাত্র ব্যবহার করেন। |