প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে চলছে গানের গুঁতোগুঁতি। আর বাজারে-বাজারে চলছে গৃহস্থের সঙ্গে মাছ ব্যবসায়ীর দরাদরি।
মঙ্গলবার সিজান উত্সবের মাছ কিনতে এসে মাছের চড়া দর দেখে কার্যত চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড় হল রাঢ়বঙ্গবাসীর। সরস্বতী পুজোর পরের দিন পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় সিজান উত্সব হয়। আর পান্তা ভাতের সঙ্গে মাছ এই উত্সবের অত্যাবশকীয় পদ। ঝোল, ঝাল, তরকারি থেকে অম্বল পর্যন্ত মাছ দিয়ে রান্না করা হয়। তাই মাছ কিনতে এ দিন দরাদরিতে পিছিয়ে থাকলেন না অনেকেই।
পুরুলিয়া শহরের বড়হাট থেকে আদ্রা বাজার, বলরামপুর থেকে মানবাজার-- সবর্ত্রই একই ছবি। পুরুলিয়া শহরের শঙ্কর নন্দী, আদ্রার শান্তনু ঘোষাল, কাশীপুরের অশেষ মোদকের গলার সুর এ দিন এক। প্রত্যেকের সার বক্তব্য, “এ বার মাছের দর যা বেড়েছে হাতই দেওয়া যায় না। কিন্তু বাড়ির কড়া নির্দেশ হরেক রকমের মাছ কিনতে হবে। তাই দরাদরি করে যতটা দাম কমানো গেল, তাতেই মাছ কিনলাম।” |
ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল যাঁরা সমবায়ের মাছ কিনতে পেরেছেন। এ দিন জেলা মীন সমবায় বিভিন্ন সমবায় থেকে মাছ সংগ্রহ করে পুরুলিয়ার বাজারে খুচরো দরে মাছ বিক্রি করেছে। এই সমবায়ের আধিকারিক উজ্জ্বলকান্তি ঘোষ বলেন, “আমরা এদিন সিএডিসি থেকে আট কুইন্ট্যাল ও কয়েকটি সমবায় থেকে আড়াই কুইন্ট্যাল মাছ এনে একশো টাকা কেজি করে দরে বিক্রি করেছি। তার সঙ্গে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের অধীনে যে সব সমবায় রয়েছে তারাও স্থানীয় বাজারে মাছ বিক্রি করেছে।” পুরুলিয়ার কোনও কোনও বাজারে এ দিন মাছ নিয়ে লটারিরও আয়োজন করা হয়েছিল। পুরস্কারের তালিকায় ছিল মাছ ও সরষের তেল। লটারি জিতে মাছ ও তেলের টিন হাতে হাসিমুখে ভাগ্যবানের বাড়ি ফিরেছেন।
সিজান পরবে মাছের দাম চড়েছে বাঁকুড়ার বাজারেও । চকবাজারের মাছ ব্যবসায়ী রাজু ধীবর, পাণ্ডা ধীবররা জানাচ্ছেন, যে কাতলা ও রুই মাছ সোমবার পর্যন্ত ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি রয়েছে, এ দিন তার দামই ৩০০ টাকা দর ছুঁয়েছিল। আবার সাত কেজি ওজনের বড় কাতলা বিকি হয়েছে ৪০০ টাকা দরে। বাঁকুড়ার পাঠকপাড়ার ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পুরাতন রথতলার অভিজিত্ দাসরা বলেন, “মাছের যা দাম বেড়েছে তাতে মধ্যবিত্তের পান্তাপাতে হরেক রকমের মাছ আর বেশি দিন দেখা যাবে না। অল্পতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া আর গতি কি!”
তবে মাছ বিক্রি এতটুকুও কমেনি। সাধারণ দিনে এই বাজারগুলিতে মাছের যা চাহিদা থাকে, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ দিন তার দশগুণ মাছ বিক্রি হয়েছে। পুরুলিয়া বড়হাটের মাছের আড়ত্দার আব্দুল জব্বার বলেন, “অন্য দিনে এই হাটে মাছের চাহিদা থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি। এ দিন মাছ এসেছে ৪৮ বাজার কেজি। সবটাই অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশা থেকে এসেছে।” এই হাটের অন্য এক ব্যবসায়ী শ্যামল ধীবর জানান, তিনি ১০ হাজার কেজি মাছ আনিয়েছিলেন। হাটের খুচরো বিক্রেতা লিল্টু ধীবরের কথায়, “অন্য দিনে আমি ২৫ থেকে ৩০ কেজি মাছ বিক্রি করি। এ দিন দেড় কুইন্ট্যালের বেশি মাছ বিক্রি করেছি।” বেশির ভাগ খুচরো বিক্রেতাই এ দিন এই অনুপাতে মাছ বিক্রি করেছেন। তার উপরে রয়েছে স্থানীয় বা দেশি মাছের কদর।
আদ্রা বাজারের আড়ত্দার আলয় দত্ত জানান, দেশি রুই বিক্রি হয়েছে ২৫০-২৮০ টাকা কেজি দরে। দেশি কাতলার দর ছিল কেজি প্রতি ২৫০ টাকার আশেপাশে। অন্ধ্রপ্রদেশের রুই-কাতলা বিকিয়েছে কেজি প্রতি ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা দরে। মৃগেল মাছের দর ছিল দেশি ২০০ টাকা থেকে ২৪০ টাকার মধ্যে। চালানি মৃগেল মাছের দর ছিল ১৬০ টাকা। অন্য মাছের মধ্যে ভেটকি ৩৫০ টাকা, পমফ্রেট ৪৫০ টাকা, পাবদা ৩৫০ টাকা, পার্শে ২৫০ টাকা, ইলিশ ৬০০-৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। মাছ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই উত্সবে সাধারণত রুই, কাতলাই চাহিদার দৌড়ে অন্যদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকে। কাশীপুর বাজারের আঘনি কৈবর্ত বা বলরামপুর বাজারের সন্তোষ ধীবরের কথায়, “বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা দেশি মাছের। যত চাহিদা ততটা জোগান নেই। দেশি মাছ বেশি দাম দিয়েই মানুষ কিনেছেন মানুষজন।” পুরুলিয়ার নামোপাড়ার গৃহবধূ লক্ষ্মী সরকার, স্বাতী সরকার বলেন, “অন্যদিন যেখানে প্রায় এক কেজি মাছ আসে। এ দিন সেখানে ন’কেজি মাছ এসেছে।” সিজান উত্সবে এক আসনে চলে এসেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও। জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সিজান উত্সবে মাছের কতরকম রান্না হয়। অন্য দিনের থেকে তাই এ দিন বেশি পরিমাণে মাছ কিনতে হয়েছে।” সিপিএমের পুরুলিয়া জোনাল কমিটির সম্পাদক কৌশিক মজুমদারের বাড়িতেও সিজান উত্সবের চল রয়েছে। তিনি বলেন, “বাড়ির চাপে মাছ তো কিনতেই হবে। সে জন্য মাছ কিনেছি।” |