বঙ্গ যৌন সাহিত্যের অপমৃত্যু
৯৮২-তে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’। তার ঠিক ষোলো বছর পর, প্রকাশিত হয় পৃথ্বীরাজ সেনের ‘তুর্কি হারেমের বন্দিনী’। ১২ দিনের বইমেলাতে ১০ দিনের মাথায় সব বই শেষ। কুমোরটুলি থেকে এই প্রকাশক একটা ‘তুর্কি হারেমের বন্দিনী’র মূর্তি অর্ডার দিয়েছিলেন। তা রাখা হয়েছিল স্টলের গেটে। সব বই বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর মূর্তিটা সরিয়ে দেওয়া হয়। আর সেখানে স্পষ্ট লিখে দেওয়া হয় ‘তুর্কি হারেমের বন্দিনী উধাও’!”
সাহিত্যিক সমরেশ বসুর পুত্র দেবশঙ্কর বসুর মতে সে সময়টা ছিল বঙ্গ যৌন সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। তাঁর প্রকাশনার স্টলের সামনে তখন থাকত পাঠকদের লম্বা লাইন।
কিন্তু এখন?
ইন্টারনেট খুললেই যে-কোনও পর্নসাইটে পৌঁছতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ সেকেন্ড। এমএমএস-এর দৌলতে মীরা-র ‘অ্যালেজড’ সেক্স ভিডিয়ো বর্ডার পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তিরুপতি থেকে বসিরহাটের সব মোবাইল ফোনে।
ইংরেজি সাহিত্যে অবশ্য এই ইন্টারনেটে সহজলভ্য যৌনচর্চাকে তুড়ি মেরে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’। যাঁরা বইটিকে সফ্ট পর্নের আখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁরাও অস্বীকার করেননি যে, এই সেক্স টয়ের যুগেও এই বইয়ে লুকিয়ে থেকেছে পাঠকদের বিনোদনের প্রচুর খোরাক।
আর সেই জনপ্রিয়তার কারণেই আজ ভ্যাঙ্কুভারে চলছে এই বইয়ের চলচ্চিত্রায়ন। পরিচালক স্যাম টেলর-উড। অভিনেত্রী ডাকোটা জনসন রয়েছেন ২২ বছর বয়সি কলেজপড়ুয়া অ্যানাস্টেসিয়া স্টিলের ভূমিকায়, যাকে হেলিকপ্টারে করে ঘুরিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে যায় শিল্পপতি ক্রিশ্চিয়ান গ্রে। ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’র ফ্যানদের কৌতূহল এখন জেমি ডোরম্যানকে নিয়ে। কী ভাবে এই হলিউড অভিনেতা ফুটিয়ে তুলবেন ক্রিশ্চিয়ানের সেই রোমাঞ্চকর উক্তি, ‘আই ওয়ান্ট টু ফা* ইয়োর মাউথ’? বিডিএসএম (বন্ডেজ, ডিসিপ্লিন, স্যাডিজম, ম্যাসোচিজম) তত্ত্বে বিশ্বাসী গ্রে-র রতিক্রিয়া কতটা গ্র্যাফিক্যালি ফুটিয়ে তুলবে হলিউড?
কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ‘ফিফটি শেডস্...’ কোথায়? না থাকলেও খুব যে বড় ক্ষতি, তেমনটা নয়। তবু ইন্টারনেটের হামলা সামলে উঠতে পারছেন কি বাংলার ‘লোলিটা’রা?
এই প্রথম বার কলকাতা বইমেলা-য় ‘তুর্কি হারেমের বন্দিনী’-র প্রকাশকের স্টলে ‘নীলছবির নীলপরীরা’র সঙ্গে রাখা হয়েছে সমরেশ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের বই। সুন্দর করে সাজানো বাংলায় ‘লোলিটা’র পাশে বিভূতিভূষণ রচনাবলি। আর ‘মধ্যরাতের জলপরী’র পাশে উঁকি মারে ফেলুদা!
আগে যে বই বছরে ৫০০০ কপি বিক্রি হত, এখন তা দু’বছর অন্তর পুনর্মুদ্রণ করতে হয়। তাও মাত্র ১০০০ কপি! এ বছর এই ধরনের কোনও বই রিলিজ করেননি ‘তুর্কি হারেমের বন্দিনী’-র প্রকাশক। তার বদলে স্টলে এসেছে কালকূটের রচনাসমগ্র। সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’র বিক্রিও ভাল। “আসলে প্রত্যেক বছর আমাদের পাঠকেরা এসে অনুরোধ করেন, যদি অন্য ধরনের বই রাখা হয়। তাই এ বছর আমরা ওদের অনুরোধ রেখেছি,” বললেন স্টলের কর্মকর্তা পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে পঞ্চাননবাবু যা বললেন না, তা হল হয়তো যুগের সঙ্গে পাঠকদের চাহিদাও পাল্টে গিয়েছে। গুগলের কল্যাণে তো আজ সব কিছুই আঙুলের ডগায়। লগ ইন করলেই খুলে যায় নিষিদ্ধ দুনিয়া।
যেখানে সানি লিওন থেকে প্রিয়া অঞ্জলি রাইয়ের জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণও এসে যায় কৌতূহলী ফ্যানের কাছে। ঘুম থেকে উঠে আলুথালু বেডশিটের আড়ালে থেকে ট্যুইটারে ছবি। রাতে লঁজারি পরে আবার ছবি।
তাই আজ সানি লিওনের ট্যুইটারে ফলোয়ারের সংখ্যা এ ভাবেই দাঁড়িয়েছে ৫ লক্ষ ৪৮ হাজার। ইচ্ছে এবং সময় থাকলেই ফ্রি পর্ন সাইট সাবস্ক্রাইব করা যায়। স্মার্টফোন থাকলে বুকমার্ক করে রেখে দিলেই ‘সবিতা ভাবি’-র দুনিয়া চিচিং ফাঁক বলে খুলে যায়।
‘কালকুট রচনা সমগ্র’র পাশেই ‘লোলিটা’। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
কিন্তু তাই বলে যে দোকানে একদম ভিড় হচ্ছে না, তা নয়। বইমেলায় এসে উত্তম ঘোষের ‘নিষিদ্ধ স্বাদ’ বইটি উল্টেপাল্টে দেখছিলেন মধ্যবয়স্ক এক পাঠক। এই ইন্টারনেটের যুগে এমন কী থাকে এই সব বইয়ে, যা অনলাইনে পাওয়া যায় না? বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে বললেন, “আছে, এমন কিছু আছে, যা ইন্টারনেটে পাবেন না।” ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে থাকে তাঁর। বিড়বিড় করে পড়ে চলেন জুলিয়া ডাবলিয়রের সেক্স-টেস্ট এর গল্প।
ঠিক তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে একদল টিনএজার। বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মুচকি-মুচকি হাসি তাদের ঠোঁটের কোনায়। “দ্যাখ কেমন লিখেছে: ‘টিয়া যখন আমাকে সোফায় শুইয়ে পাউডার মাখাচ্ছিল, তখন সারা ঘরময় সেই রকম কটু আর সুগন্ধ মেশানো একটা বাতাস বইছিল...’ এই রকম বর্ণনা পড়লে তো হাসি পাচ্ছে,” একজোটে বলেন তাঁরা। একজন দলছুট হয়ে তুলে নেন আরও একটা বই। মলাটে লেখা ‘রাতপরীদের ব্যাঙ্কক’। “লেখক নিজে ব্যাঙ্কক গিয়ে তার পর এই বইটা লিখেছেন,” বললেন স্টল-য়ের এক বিক্রেতা।
এক সময় মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে ব্যাঙ্কক-পটায়া ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। আজকাল দিল্লি, মুম্বই যাওয়ার সমান খরচেই ব্যাঙ্কক চলে যাওয়া যায়। ঘুরে দেখা যায় সেখানকার ওয়াকিং স্ট্রিট। যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করাটা আর অসুবিধের নয়, সেখানে এই বইয়ের কদর কতটা?
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য খান পঞ্চাশেক বই লিখেছেন আশির দশকের এক কবি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। হাসতে হাসতে বলছেন তিনি, “এক সময় ‘বারবধূদের ডায়েরি’ বলে একটা বই লিখতাম আমি। যখনই নগদ টাকার দরকার হত, সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের কিছু গল্প লিখে ফেলতাম। প্রকাশকের হাতে পাণ্ডুলিপি দিলেই নগদ টাকা পেয়ে যেতাম। এমনও হয়েছে যে দিনে পাঁচটা গল্প লিখেছি। এটা আজ থেকে বছর পঁচিশ আগের ঘটনা।” গল্প পিছু ২৫০ টাকা, কলম পিছু পেতেন ১০০ টাকা। শুধু একটাই শর্ত ছিল। “যে ভাবেই লেখা শুরু করি না কেন, কয়েক লাইনের পরেই প্রোটাগনিস্টকে বিছানায় নিয়ে যেতেই হবে। খুঁটিয়ে বিবরণ দিতে হবে। রোমাঞ্চকর গল্প লিখতে হত পাড়ার বৌদি এবং হাঁটুর বয়সি দেওরকে নিয়ে। এমন ভাবে লিখতে হবে যে পাঠকের যেন পূর্ণ পরিতৃপ্তি হয়। বইয়ের অদ্ভুত সব নাম। ‘হারেমের অন্দরমহল’, ‘পরিতৃপ্তির শেষ কথা’ থেকে ‘বিছানার আদি এবং অন্ত’ আর ‘বৌদির ইশারা’,” বলছেন সেই কবি।
নব্বইয়ের দশকে সেই সব বইয়ের কী অমোঘ হাতছানি! বলছেন এক পাঠক, “হোস্টেলে থাকতে রাত দশটায় আলো নিভে যেত। তার পর শুরু হত নিষিদ্ধ সাহিত্যচর্চা। লেপ কিংবা চাদর দিয়ে সারা শরীর তাঁবুর মতো ঢেকে ফেলা হত। তার পর টর্চ জ্বালিয়ে হলুদ সেলোফেনে মোড়া বই পড়া শুরু।” সেই পাঠকের এক বন্ধু বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের কালেকশন নিয়ে আসতেন। “সেগুলো ছিল হট কেক। মনে আছে ওই বন্ধু ছুটি থেকে যখন হোস্টেলে ফিরত, ওর রুমের সামনে লাইন পড়ত বই সংগ্রহের জন্য। সে কী ভাষা! কেউ লিখছেন ‘দক্ষ খেলুড়ে আঙুলের আনাগোনা’। কেউ দিচ্ছেন উঠতি বয়সের নারীর ফিনফিনে নাইটির বর্ণনা। টিভি নেই তো কী হয়েছে এ সব বর্ণনা ঘুম কেড়ে স্বপ্ননীল দৃশ্য ফুটিয়ে তুলত চোখের সামনে,” বলছেন তিনি।
কলেজে পড়াকালীন কবি শ্রীজাত-র হাতেও এ ধরনের বই এসেছে। “আমাদের এক বন্ধুর হলুদ সাহিত্যের বিশাল কালেকশন ছিল। একটা র্যাক ভর্তি এই সব বই ও ব্রাউন পেপারে মলাট দিয়ে রাখত। মলাটের উপর লেখা থাকত ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, অথবা ‘ফিরে এসো চাকা’। আমরা তা দেখে দারুণ ইমপ্রেসড। পরে জানলাম এই সবই ওর বাবার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার কারসাজি। বাবা ভাবতেন ছেলে বাংলা কবিতায় মজেছে। আসলে ও পর্নো পড়ত। তবে অনেকেই যৌন আনন্দ নেওয়ার জন্যই এই বইগুলো পড়ত। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ওই সাহিত্যের ভাষা ও শৈলী থেকে নিখাদ মজা পাওয়া,” বলছেন শ্রীজাত।
ক্যাকটাস-য়ের সিধু বলছেন ডাক্তারি পড়ার সময়, ‘হ্যান্ডি-পনর্’ হিসেবে এই হলুদ বইগুলো ছিল বিশাল হিট। “এমন সব শব্দ ব্যবহার হত, যা আর কোনও দিন কোথাও পড়িনি। ভোক্যাবুলারিই পাল্টে দিত। একটা চরিত্র আজও মনে রয়েছে। তা হল রত্না বৌদি,” বলছেন সিধু। তবে ইন্টারনেটের যুগে হয়তো এই ধরনের বইয়ের কদর না থাকাটাই স্বাভাবিক, বলছেন তিনি।
ছাত্রজীবনে মনে আছে
পড়েছিলাম ‘হরিদাসীর গুপ্তকথা’

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
কলেজে পড়াকালীন ‘শারদীয় বাসনা’
পড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম

শ্রীজাত
ডাক্তারি পড়ার সময় আমার প্রিয়
হলুদ বইগুলোর মধ্যে ছিল
‘কোক শাস্ত্র’
সিধু
“আমার এখন ও ভাবে রোজগার করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটাও বুঝি যে ইন্টারনেট থাকলে এগুলোর থেকে অনেক বেশি কিছু হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন পাঠকেরা। পড়ার কষ্ট না করে শুধু ইউটিউবে দেখেই তাঁরা তৃপ্তি পাবেন। আইটেম নাম্বার, বেলি ডান্স সবই তো আজকাল হিন্দি সিনেমাতেই রয়েছে। তা হলে আর এই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আলাদা করে বই লেখার কী দরকার?” প্রশ্ন সেই প্রাক্তন ‘পর্ন’ লেখকের।
তবু আরও একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায়। ইন্টারনেটের সহজলভ্য ইরোটিক সাহিত্যের প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও তো ‘ফিফটি শেডস্’য়ের আজ এত রমরমা। তা হলে বাংলাতে কেন সেই ঘরানাটা জনপ্রিয় হল না? দেবকুমার বলেন, “শুধু গ্রাফিক বর্ণনা দিলেই কিন্তু এ সব সাহিত্য টিকে থাকবে
না। ইন্টারনেট আরও জনপ্রিয় হলে পাঠকের সংখ্যা আরও কমবে। আমি নিজে ৫-৬টা বই লিখেছি। তার মধ্যে আছে ‘বারো নারী’, ‘নারী-পুরুষ’। নামগুলো যদিও একটু অন্য ধরনের, তবে বইগুলো কিন্তু শুধু মাত্র যৌনতাকে কেন্দ্র করে লেখা নয়। তবে এই সাহিত্য নিয়ে চর্চা করার মতো লেখকের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ইন্টারনেটের রমরমায় হয়তো এক সময় পাঠকের সংখ্যা শূন্যতে ঠেকবে!”
শেষ কথাটা বলছেন শ্রীজাত। “আজকাল বই পড়া কমে গিয়েছে। কিন্তু এই ধারার মজাটা হারিয়ে যাবে না। পাঠকসংখ্যা কমতে পারে, কিন্তু এই ধারার যে লেখা সেটা এখনও ইন্টারনেটে উপলব্ধ নয়। এটার মজা পেতে গেলে আজও ফুটপাথের সেই চটি বইগুলো ঘাঁটতেই হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.