কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালের শিশুবিভাগে জরুরি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ২ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করেছিল স্বাস্থ্যদফতর। কিন্তু সেই তালিকা থেকে সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতাল-সহ কলকাতার প্রথম সারির তিন মেডিক্যাল কলেজ বাদ যাওয়ায় দফতরের অন্দরেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় গুরুতর অসুস্থ শিশুদের নিয়ে আসা হয় সেখানেই যথেষ্ট যন্ত্র না থাকলে উৎকৃষ্ট চিকিৎসা কী ভাবে হবে, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
এসএসকেএম-এর পাশাপাশি সরকারি টাকা পায়নি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুবিভাগও। অথচ স্বাস্থ্যকর্তারাই মানছেন, গত প্রায় ১ বছর ধরে ওই হাসপাতালগুলি শিশুবিভাগের যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে দফায়-দফায় চিঠি দিয়েছে। ওই তিন হাসপাতালেই শিশুবিভাগের আওতায় ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ বা এসএনসিইউ রয়েছে, যেখানে অতি সঙ্কটজনক শিশুদের পরিষেবায় উন্নতমানের যন্ত্র দরকার। পাশাপাশি, প্রথম সারির মেডিক্যাল কলেজ হওয়া সত্ত্বেও এসএসকেএম ও ন্যাশনাল মেডিক্যালের এসএনসিইউ-এ অক্সিজেন পাইপলাইন পর্যন্ত বসেনি! সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে ব্যবহার হচ্ছে সিলিন্ডারে ভরা অক্সিজেন।
অভিযোগ উঠেছে, কীসের ভিত্তিতে ওই তিন হাসপাতাল শিশুবিভাগের যন্ত্রপাতি কেনার টাকা পাওয়ার তালিকা থেকে বাদ গেল, তার কোনও কারণ দেখাতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। টাকা পেলে পাইপলাইন চালু করাও সহজ হত। অথচ এর থেকে ছোট মাপের হাসপাতাল চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের যন্ত্রপাতি কিনতে ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ৬০ লক্ষ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, ৭০ লক্ষ আর জি করের শিশুবিভাগ এবং ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে বিসি রায় শিশু হাসপাতালের জন্য। কিন্তু এসএসকেএম, এনআরএস, ন্যাশনালের শিশুবিভাগের প্রাপ্তি শূন্য।
রাজ্যে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজরদারির জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে বলেন, “ওই হাসপাতালগুলি আমাদের কাছে শিশুবিভাগ বা এসএনসিইউ-এর জন্য কোনও যন্ত্রপাতি চেয়ে তালিকা পাঠায়নি। না চাইলে জানব কী ভাবে ওদের কী দরকার?” এই যুক্তি কিন্তু সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলি মানতে চায়নি। এসএসকেএম-এর শিশুবিভাগ তথা নবজাতক বিভাগের চিকিৎসকদের দাবি, ২০১৩-র মে মাস থেকে যন্ত্রপাতি চেয়ে বারবার চিঠি লিখেছেন তাঁরা। তাও টাকা বরাদ্দ করা হয়নি। চিকিৎসকেরা আরও জানিয়েছেন, ২০টি সিরিঞ্জ পাম্প, ইনফিউশন পাম্প, ২টি আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইকো কার্ডিওগ্রাম মেশিন, ১০টি রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার, ৫টি ফটোথেরাপি মেশিন এবং ৪টি পাল্স অক্সিমিটার জরুরি প্রয়োজন। কিন্তু একবছর ধরে টাকার অভাবে কেনা যাচ্ছে না। শিশুবিভাগে খরচ করার জন্য প্রায় আড়াই বছর আগে সাংসদ তহবিলের প্রায় ১ কোটি টাকা এসেছিল। সেটিও কোনও অজ্ঞাত কারণে হাসপাতালের অ্যাকাউন্টে পড়ে রয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। এ কথা অবশ্য মেনে নিয়েছেন এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রও।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হল, টাকার অভাবে সেখানে এসএনসিইউ-এ পাইপলাইনে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কোনও শিশুকে ভেন্টিলেশনে দিতে হলেই সমস্যায় পড়ছেন চিকিৎসকেরা। এ বিষয়ে ত্রিদিববাবুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এসএসকেএম-এর কয়েকজন চিকিৎসক যন্ত্রপাতির তালিকা নিয়ে কিছুদিন ধরে আসছেন। পাইপলাইনে অক্সিজেন আর আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।” তা হলে যে আগে বলা হল, কোনও তালিকাই ওই হাসপাতালগুলি পাঠায়নি? ত্রিদিববাবুর জবাব, “আগে পাঠায়নি, দিন তিনেক হল পাঠিয়েছে।”
ন্যাশনাল মেডিক্যালের শিশুবিভাগের চিকিৎসকেরাও জানিয়েছেন, তাঁদের এসএনসিইউ-তেও পাইপলাইনে অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। কোনও শিশুর ভেন্টিলেটর লাগলে তাকে হাসপাতালের অন্য ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। বিভাগে পরিষেবা দিতে এসএনসিইউ-এ অবিলম্বে ২০টি রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার, ৩০টি পাল্স অক্সিমিটার, ২০টি ফটোথেরাপি মেশিন জরকার। নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটে দরকার অন্তত ৭টি মাল্টিচ্যানেল মনিটার, ১০টি পাল্স অক্সিমিটার। একাধিকবার এই তালিকা স্বাস্থ্যভবনে গিয়েছে। শেষবার পাঠানো হয়েছে মাস দেড়েক আগে। তা-ও টাকা বরাদ্দের তালিকা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ত্রিদিববাবু এ ব্যাপারে বলেন, “টাকা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। স্বাস্থ্যদফতরে অনেক টাকা পড়ে আছে। কারও সঙ্গে আমাদের শত্রুতাও নেই। সময়মতো সবাই পেয়ে যাবে।” |