শান্তি শবরের জীবনটাই বদলে দিয়েছে আমবাগান।
চাষবাস জানা ছিল না। জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে, মাটি খুঁড়ে সাদা পাথর বেচেই দিন গুজরান হত। পুলিশ-প্রশাসনের লোক দেখলে ত্রিসীমানায় থাকতেন না। বছর পাঁচেক আগে বিডিও বাবুলাল মাহাতো যখন আমবাগান করতে বলেছিলেন, প্রথমে বিশেষ গা করেননি। তার পরে দেখলেন, সরকারই আমবাগানের জমি জোগাড় করে দিচ্ছে। বাগানে কাজ করলে একশো দিনের কাজের মজুরি মিলবে। আর গাছে আম ফলতে শুরু করলে তা বিক্রি করেও আয় হবে। হয়েছেও তাই। শান্তি শবরের বড় ছেলে পড়াশোনা না শিখলেও ছোট ছেলে বিএ পাশ করেছে। শান্তি শবর এখন কলকাতা থেকে দিল্লি ঘুরে তাঁর বদলে যাওয়া জীবনের গল্প বলেন। |
ব্রিটিশ জমানায় সরকারি খাতায় যাদের পরিচয় ছিল অপরাধপ্রবণ জাতি হিসেবে, পুলিশ চাইলেই যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারত, গ্রামের পুরুষরা সারা দিন নেশাভাং করে পড়ে থাকতেন, সেই শবরদেরই উন্নয়নের কাজে সামিল করার জন্য আজ জাতীয় সম্মান আদায় করে নিল বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। বিজ্ঞান ভবনে বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতীর হাতে শংসাপত্র তুলে দিলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। একশো দিনের কাজ প্রকল্পের মাধ্যমে গরিবদের জন্য পাকাপাকি ভাবে জীবিকার বন্দোবস্ত করার জন্য দেশের প্রথম ন’টি জেলার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাঁকুড়া। দিল্লিতে এসে লিপগিরি গ্রাম পঞ্চায়েতের শান্তি শবর, সরস্বতী হেমব্রমরা শুনিয়েছেন, তাঁদের বদলে যাওয়া জীবনের কথা। পতিত জমিতে আম চাষ করে জীবনের সোনা ফলানোর কথা।
কিন্তু এখানেই থামছে না বাঁকুড়ার খাতড়া মহকুমা। এত দিন যে জমি পতিত বলেই জানত লোকে, আমের পর এ বার সেখানে লাল আঙুর চাষ হচ্ছে। মহকুমার কর্তারা জানাচ্ছেন, নাগপুরের গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, বাঁকুড়ার ওই এলাকার জল-মাটি নাকি কমলালেবু চাষের জন্য আদর্শ। এ বার সেখানে কমলালেবু চাষ শুরু করবেন শবর উপজাতির লোকেরা। আম গাছে গত বছর থেকেই ফলন আসতে শুরু করেছে। আম্রপালি, মল্লিকা জাতের আম ভালই বিকিয়েছে বাজারে। আগামী দিনে পুরোপুরি জৈব পদ্ধতিতে চাষ করে সেই আম রফতানির পরিকল্পনা চলছে।
কী ভাবে হল এই অসাধ্যসাধন?
জেলাশাসক বিজয় ভারতী জানান, ২০০৯ সালে প্রথমে খাতড়া মহকুমায় আমবাগান করার চেষ্টা শুরু হয়। বিডিও হিসেবে বাবুলাল মাহাতোই কাজটা শুরু করেছিলেন। পুরুলিয়ার মানুষ বলে স্থানীয় ভাষাটাও জানা ছিল তাঁর। তাই শবরদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেন তিনি। প্রথমে গাছ পোতা হত, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা মরেও যেত। কারণ শবররা মনে করতেন, ও সব সরকারের গাছ। মাথা খাটিয়ে শবরদের নিয়েই স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে দেওয়া হল।
এর পরে আমবাগান করার জন্য লিজে জমি পাইয়ে দেওয়া হল তাঁদের। নিজেদের জমিতে নিজেদের গাছ পুঁতলেন শবররা। বাগানের দেখাশোনা করার জন্য একশো দিনের কাজের মজুরিও মিলল। শান্তি শবর বলছিলেন, “ঘর করা ছাড়া চাষের জমি ছিল না। লিজে জমি পেলাম। দেখলাম, ফল, সব্জি হলে দু’পয়সা রোজগার হবে। আবার মজুরিও মিলবে।” সেখান থেকেই শুরু। ২০০৯ সালে ১৮টা বাগান করা হয়েছিল। চারা পোতা হয়েছিল ৩০ হাজার। পাঁচ বছরে তা বেড়ে এখন ১৫৮টি বাগান। দেড় হাজারেরও বেশি আমগাছ। সবটাই পতিত জমিতে। গত মরসুমে ১৩২ মেট্রিক টন আম ফলেছে। বিক্রির পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়েও আম দিয়ে এসেছেন শান্তি-সরস্বতীরা। দিল্লিতে নিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার ভাস্কর খুলবে-র কথায়, “গোটা কাজটাই হয়েছে একশো দিনের কাজের সঙ্গে হর্টিকালচার মিশন, ক্ষুদ্র-সেচের প্রকল্পের সমন্বয় সাধন করে।”
বাঁকুড়ার পাশাপাশি নানা সরকারি প্রকল্প ও বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলার জন্য আজ গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সম্মান আদায় করে নিয়েছে বাঁকুড়ারই কোতুলপুরের লেগো গ্রাম পঞ্চায়েত। দেশের সেরা ১১টি গ্রাম-পঞ্চায়েতের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে এত দিনের অখ্যাত লেগো। |