আনকোরা শৃঙ্গে পা উস্কে দিচ্ছে বাঙালির নতুন স্বপ্ন
প্রবাদে বলে, মহাজনেরা যে পথে যান, সেই পথই পথ। কিন্তু অভিযাত্রীদের কাজ হল, নতুন পথের সন্ধান করা! গতানুগতিক রাস্তায় হাঁটার রেওয়াজ ছেড়ে আনকোরা নতুন শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্নই দেখেছিলেন এক দল বাঙালি তরুণ! কারাকোরাম পর্বতের মাউন্ট প্ল্যাটো-য় প্রথম বার পা রেখে সেই স্বপ্নই সফল করেছেন তাঁরা।
এভারেস্ট-ধবলগিরি-কাঞ্চনজঙ্ঘার আকর্ষণ ছেড়ে, আট-হাজারি উচ্চতার মোহে না ভুলে মাউন্ট প্ল্যাটো (উচ্চতা ৭ হাজার ২৮৭ মিটার) কেন?
ওই যে অচেনা, আনকোরা, আগে কেউ ছুঁতে পারেনি সেটাই তো আনন্দ। বলছিলেন ওঁরা, মাউন্ট প্ল্যাটো জয়ী দলটি। পর্বতারোহণের পরিভাষায় একে বলে ‘ভার্জিন পিক’। বিদেশিরা এমন শৃঙ্গে উঠবেন বলে সারা পৃথিবী চষে ফেলেন। পর্বত অভিযানের সঙ্গে যুক্ত লোকজন মনে করছেন, বাংলাও যে এমন একটা কাজ করায় উৎসাহ পেল, তাতে এ রাজ্যে পর্বতারোহণ অভিযান এগিয়ে গেল কয়েক কদম।
১৯৭৭ সালে ত্রিশূলি শৃঙ্গ জয় করেছিল বাঙালিদের একটি দল। তখন সেটি ছিল অসামরিক উদ্যোগে বাংলার প্রথম সাত হাজার মিটারের ‘ভার্জিন পিক’ অভিযান। তার পরে ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই মাউন্ট প্ল্যাটো-তে পদার্পণ। দু’টি জয়ের ব্যবধান ৩৬ বছর। এই সময়ের মধ্যে অচেনা শৃঙ্গে অভিযান যে একটাও হয়নি তা নয়, কিন্তু সে সব ক’টিই সাত হাজার মিটারের কম উচ্চতার। অথচ মাঝের এই সময়টুকু এ রাজ্যে পর্বতারোহণের ইতিহাসে মোটেই হেলাফেলার নয়। এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা তিন-তিনটে আট-হাজারি শৃঙ্গ জয় করা হয়ে গিয়েছে।

প্ল্যাটো শৃঙ্গে দেবরাজ দত্ত।
কিন্তু এগুলো তো সবই পরিচিত শৃঙ্গ। অচেনা পথে পা বাড়াতে এই বিলম্ব কেন! এই নিয়ে এখনও আক্ষেপ যায়নি দেবরাজ দত্তের, প্ল্যাটো শৃঙ্গ অভিযানের দলনেতার। বলছিলেন, হিমালয়ের কয়েকশো শৃঙ্গের মধ্যে নিয়মিত ভাবে অভিযান হয় হাতে গোনা খান কুড়ি শৃঙ্গে। অথচ চেনা পথের বাইরে একটু পা বাড়ালেই সুযোগ মেলে অনেক নতুন অভিযানের। জানালেন, এমনই একটি নতুন শৃঙ্গ মাউন্ট প্ল্যাটো অভিযানের জন্য কত আগাম পরিকল্পনা করতে হয়েছে, কষতে হয়েছে কত চুলচেরা হিসেব। এখন বাংলার পর্বত অভিযান মহলের সেই অধ্যবসায়টাই নেই।
কেন নেই? সম্প্রতি এভারেস্ট শীর্ষে উঠেছেন উজ্জ্বল রায়, এখন রাজ্য সরকারের যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ বিভাগের উপদেষ্টা। তিনি বলছিলেন, ভার্জিন পিক অভিযান যে হয় না, তার কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, এভারেস্টের মতো জনপ্রিয় শৃঙ্গ জয় করলে যতটা প্রচার পাওয়া যায়, অচেনা শৃঙ্গের ক্ষেত্রে তা নেই। আর প্রচার না থাকলে নেই স্পনসরও।
প্রথম অসামরিক বাঙালি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেছিলেন দেবাশিস বিশ্বাস। কথায় কথায় তিনি জানালেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো পরিচিত শৃঙ্গে অভিযানের সময়েও টাকা জোগাড় করতে দোরে দোরে ঘুরতে হয়েছিল। “তা হলে আনকোরা শৃঙ্গের ক্ষেত্রে কী হতে পারে, সেটা বুঝে দেখুন।” দ্বিতীয়ত, আনকোরা শৃঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগের অভাব। উজ্জ্বলবাবু বললেন, “গতানুগতিকতার বাইরে বেরোনোর জন্য যতটা আগাম পরিকল্পনা বা পরিশ্রম করতে হয়, আজকের প্রজন্ম তা করতে নারাজ। আর পড়াশোনার অনিচ্ছা তো রয়েছেই।”
পরিশ্রমের অভাব নিয়ে এই অভিযোগটাই ভেঙে দিতে চেয়েছেন দেবরাজরা। মাউন্ট প্ল্যাটো আরোহণের প্রস্তুতি পর্বে বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে তাঁদের। শৃঙ্গটি যে হেতু কারাকোরাম পর্বতমালায়, তাই ওই অঞ্চলের মানচিত্র জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় পাওয়া যায়নি। রাশিয়ার কনটুর মানচিত্র জোগাড় করতে হয়েছে। কারাকোরাম রেঞ্জে একের পর এক অভিযান করে জেনে নিতে হয়েছে এই এলাকায় পর্বতারোহণের সমস্যাগুলো। তার পরেও সহ্য করতে হয়েছে বেশ কয়েকটা ব্যর্থ অভিযানের ধাক্কা। দেবরাজবাবু বললেন, “২০১১ সালে যখন সাসের কাঙরি-৪ শৃঙ্গে অভিযানে গিয়েছিলাম, তখন বেশ কাছ থেকে প্ল্যাটোর রুটের কিছু ছবি তুলেছিলাম। সাসের কাঙরি-৪ এবং প্ল্যাটোর রুট ক্যাম্প ওয়ান পর্যন্ত একই। কিন্তু তার পরের রুট ওপেনিং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে করতে হয়েছিল।”
আনকোরা শৃঙ্গ আরোহণকেই প্রকৃত অভিযান বলে মনে করেন উজ্জ্বলবাবু। তাই তিনি সাধুবাদ দিচ্ছেন দেবরাজদের। একই কথা বলছেন দেবাশিস বিশ্বাসও।
কতটা কঠিন ছিল প্ল্যাটো জয়?
দেবরাজবাবু জানালেন, কারাকোরাম হিমালয়ে অভিযানের সব চেয়ে বড় বাধা হল আবহাওয়া। ‘টিবেটান প্ল্যাটো উইন্ড’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলের হাওয়া প্রায় তুষারঝড়ের মতোই ভয়ঙ্কর। তাঁর কথায়, “তৃতীয় ক্যাম্প অর্থাৎ সামিট ক্যাম্পে (যেখান থেকে শুরু হয় শীর্ষে চূড়ান্ত আরোহণের জন্য হাঁটা) পৌঁছনোর পর আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, আমরা আবার প্রথম ক্যাম্পে নেমে চলে আসি। তুষারপাতের গতিবিধি দেখে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়। সাত দিন অপেক্ষা করার পর আট দিনের দিন ফের শুরু করি।” খারাপ আবহাওয়া ছাড়াও ভয় ছিল উপর থেকে পাথর পড়ার। ছোটখাটো তুষারধসের মুখেও পড়েছিল চার অভিযাত্রী ও পাঁচ শেরপার দলটি।
এখন প্রশ্ন, প্ল্যাটো শৃঙ্গ জয় কি বাংলার পর্বত অভিযানের চরিত্রে কোনও বদল আনবে?
দেবরাজের হিমালয়ান ক্লাব বলছে, তারা এমন নতুন পথেই হাঁটতে চায়। যে সমস্ত সাত হাজারি শৃঙ্গ এখনও অধরা, সেগুলিই এর পর তাদের লক্ষ্য। সেই তালিকায় রয়েছে ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখার উপর অবস্থিত সলতরো কাঙরি (৭,৭৪২ মিটার বা ২৫ হাজার ৫৪৮ ফুট), যেখানে এখনও পর্যন্ত কোনও ভারতীয় অসামরিক অভিযান হয়নি। দেবরাজবাবুর কথায়, “নতুন আরোহীরা নতুন শৃঙ্গ বা নতুন রুট বেছে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিক। চ্যালেঞ্জ নিক প্রকৃত অভিযানের, শুধুই উচ্চতা মাপার নয়।”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.