অরুণাচল প্রদেশ হইতে রাজধানী দিল্লিতে পড়িতে আসা প্রথম বর্ষের এক কলেজ ছাত্রকে যে ভাবে লাজপতনগরে পিটাইয়া মারা হইয়াছে, তাহাকে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলিয়া ধরিয়া লইলে বড় ভুল হইতে পারে। এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, ইহার নেপথ্যে রহিয়াছে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগোষ্ঠীর প্রতি ‘মূল স্রোত’-এর ভারতীয়তার বিরূপতা। নিদো টানিয়াম-এর চেহারা, চুলের রঙ ইত্যাদি লইয়া ব্যঙ্গবিদ্রুপ, কটাক্ষ ও আপত্তিকর নানা মন্তব্যই যুবকটির প্রতিক্রিয়া আহ্বান করে। মূল স্রোতের ভারত যেন এই প্রান্তিক জনের তরফে এমন প্রতিক্রিয়ার জন্যই অপেক্ষা করিয়াছিল। অন্তত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনজাতিরা তেমন কথা মনে করিলে তাঁহাদের বোধহয় খুব দোষ দেওয়া যাইবে না।
এই মনোভাবের প্রমাণ দিল্লিতে ইতিপূর্বেও একাধিক বার মিলিয়াছে। মণিপুর সহ উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যের পড়ুয়াদের সহিত নাগরিকরা এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ বহু বার করিয়াছেন। রাজধানীতে পড়াশুনা কিংবা কর্মসংস্থানের জন্য অভিবাসী এই সব জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা রাস্তায়-ঘাটে, দোকানে-বাজারে, কলেজ-হস্টেলে কিংবা কর্মস্থলে সহপাঠী বা সহকর্মীদের কাছ হইতে এমন বিরূপ আচরণ পাইতে অভ্যস্ত। তাঁহাদের ভারতবাসী বলিয়া গণ্য করিতেও অধিকাংশেরই দ্বিধা। অনেকেই তাঁহাদের ‘চিনা’ বলিয়া ভুল করেন। আর, জাতীয়তাবাদী প্রতর্কে চিনারা যেহেতু বহু নাগরিকের চোখেই প্রতিপক্ষ, তাই মঙ্গোলয়েড জনজাতির এই লোকেদেরও সর্বদাই সন্দেহ ও বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। কিছু কাল আগেই অসমের বড়ো জনজাতির সহিত মুসলিমদের হানাহানি সাম্প্রদায়িক চেহারা লইলে দক্ষিণ ভারতেও বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন উত্তর-পূর্বের মঙ্গোলয়েড জনজাতিদের সন্ত্রস্ত করে। তাঁহারা দলে-দলে ট্রেনযোগে ফিরিতে থাকেন। সামান্য প্ররোচনায়, এমনকী বিনা প্ররোচনাতেও এই যে জাতিবৈর, অপরিচিত সহনাগরিক বা প্রতিবেশীর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার মনোভাব, ইহা দেখাইয়া দেয়, ভারতের গণতন্ত্রের সাধনা এখনও কতটা অসম্পূর্ণ। গণতন্ত্র মানে কিন্তু বহুসংস্কৃতিবাদও বটে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠী, সেই জনগোষ্ঠীর পীত গাত্রবর্ণ, তাঁহাদের অচেনা লোকাচার, পূজার্চনা পদ্ধতি, স্বতন্ত্র খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, নৃত্যগীত, সংস্কৃতি, তাঁহাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধ ও সাম্যচেতনা অবশিষ্ট ভারতের জীবনচর্যা হইতে আলাদা। কিন্তু আলাদা হইলেই তাহা সন্দেহজনক হইবে কেন?
সত্য ইহাই যে, ভারতীয় জাতীয়তার চেতনায় উত্তর-পূর্বের মঙ্গোলয়েড জাতিসত্তার সংস্কৃতির আত্তীকরণ ঘটে নাই। তাঁহাদের ধারাবাহিক ভাবে ‘অপর’ করিয়া রাখা হইয়াছে। ভৌগোলিক, প্রশাসনিক, সাম্রাজ্যিক এবং রণনৈতিক স্বার্থে এই অঞ্চলকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে বটে, তবে আপন করিয়া লওয়ার কোনও চেষ্টা হয় নাই। তাঁহারাও যে ভারতবাসী, ভারতের বহুভাষাসংস্কৃতির পরিপুষ্টি ও সমৃদ্ধির সমান অংশীদার, এই বিষয়টি আর্যাবর্ত কিংবা দক্ষিণাপথের ভারতীয়দের উপলব্ধিতে থাকে না। অরুণাচলের তরুণ নিদো টানিয়ামের সেই অপমান পরিপাক হয় নাই। তিনি প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিলেন। আর্যাবর্ত তাঁহাকে বুঝাইয়া ছাড়িল যে, প্রান্ত কখনও কেন্দ্রের সমান হইতে পারে না। ইহাকে এক অর্থে বর্ণবৈষম্য না বলিয়া কোনও উপায় নাই। এবং বরং তাহার প্রকাশ উত্তরোত্তর হিংস্রতর হইতেছে। প্রজাতন্ত্রের সংকট গভীর। |