কিছু কাল আগেই যেখানে নির্বাচনের নামে গুন্ডামি চলিতেছিল, বত্সর পুরাইবার আগেই সেই স্থানে যদি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে নূতন মাত্রা যুক্ত হয়, প্রশংসা না করিয়া উপায় নাই। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় তাহার সাম্প্রতিকতম ছাত্র-নির্বাচনটি লইয়া গৌরববোধ করিতে পারে। এবং প্রেসিডেন্সির এই দৃষ্টান্তে গোটা পশ্চিমবঙ্গ আশ্বস্ত বোধ করিতে পারে। সদিচ্ছা ও সত্ প্রশাসনের মাধ্যমে কী ও কতখানি পরিবর্তন সাধিত করা যায়, তাহার উজ্জ্বল প্রমাণ এই নির্বাচন। কেবল সুষ্ঠু সংঘটনই একমাত্র বিষয় নয়, নির্বাচনী ফলাফল শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রকাশই বড় কথা নয়, নির্বাচনের আগে যে ভাবে সকল প্রার্থী সম্মিলিত ছাত্রসমাজের সামনে আসিয়া নিজের অবস্থান ও ভাবনাচিন্তা নিজ মুখে ব্যক্ত করিবার অবকাশ পাইয়াছেন, তাহা অভূতপূর্ব বলিলে অত্যুক্তি হয় না। ইতিপূর্বে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সভার কথা কলিকাতা শুনিয়াছে, কিন্তু এ রাজ্যে এই ঘটনা প্রথম। নিঃসন্দেহে উক্ত বিতর্ক-আলোচনাসভাটি প্রেসিডেন্সির এ বারের ছাত্র-নির্বাচনের প্রধান জয়টীকা।
উত্কর্ষের সন্ধানে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, তাহার ভূমিতে ছাত্র-নির্বাচনের এই নূতন দিগন্ত অন্যত্রও প্রসারিত হইবে, আশা রহিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যদিও ইতিমধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন, বৃহত্তর বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে এমন নির্বাচন-পূর্ব আলোচনা-সভা করা আদৌ সম্ভব কি না। সন্দেহের একটিই উত্তর: করিবার চেষ্টা। চেষ্টা থাকিলে হয় না, ইহা সত্যই বিরল। কিন্তু, নির্বাচনের আকার-প্রকার, প্রার্থীসংখ্যা, কোনওটিই আলোচনামূলক নির্বাচনী অভিজ্ঞতার পথে মূল বাধা নয়। বাধা একটিই: মানসিকতা। কড়া প্রশাসন ও সদিচ্ছা দ্বারা সেই মানসিকতায় পৌঁছাইবার চেষ্টা করা যায় না কি? একটি যুক্তি: রাজনৈতিক ‘দলবাজি’ হইতে কিছুটা সরিতে পারা গিয়াছে বলিয়াই প্রেসিডেন্সিতে সাফল্য সম্ভব হইল। প্রাঙ্গণ-বহির্ভূত দলের চিহ্ন নির্বাচনে ছিল না কি ছিল না, তাহা প্রশ্নযোগ্য। কিন্তু দলের প্রবল উপস্থিতি যে ছিল না, তাহা চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় ধরা পড়িয়াছে। অন্য ক্ষেত্রে এতটা সাধন করা যাইবে কি না, ইহাই আসল প্রশ্ন। কিন্তু বিন্দু বিন্দু জলকণার মতো বিন্দু বিন্দু সুদৃষ্টান্তও জরুরি, সম্ভাব্যতা যে অসীমপ্রসারী তাহা প্রমাণের জন্য। দল-মানসিকতা যে সুস্থ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পক্ষে কত বড় বাধা হইয়া উঠিতে পারে, তাহা প্রেসিডেন্সির ঘটনাটি হইতে স্পষ্ট। এই আলোচনা-সভার মুখ্য লক্ষ্যই হইল, সকলকে কথা বলিবার সুযোগ দেওয়া। প্রার্থীরা কী করিতে চাহেন, কেন করিতে চাহেন, কী তাঁহাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য, তাহা এই সভায় পেশ করিবেন, শ্রোতৃ-আসন হইতে প্রশ্ন উঠিয়া আসিলে মোকাবিলা করিবেন, এবং এই পারস্পরিক আদানপ্রদানের পদ্ধতিতে অন্যান্য প্রার্থী বা শ্রোতা কোনও বিঘ্ন ঘটাইবেন না। এইটুকুই অসম্ভব করিয়া তুলিতে পারে হিংস্র দল-মানসিকতা, যাহাদের কাছে অপর পক্ষকে কথা কহিতে দেওয়ার অর্থ নিজের পক্ষের পরাজয়ের পথে এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। সুতরাং, প্রার্থী কে, কেমন, কী চাহেন, এই সব বিশেষ কিছু না দেখিয়া-জানিয়াই দলের ছাপে প্রার্থীর পরিচয় স্থির হইয়া যায়, ভোট পাওয়া বা না-পাওয়া নির্ধারিত হইয়া যায়। এই অর্থে আলোচনা-ভিত্তিক গণতন্ত্র আর দলতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মধ্য তীব্র অন্তর্বিরোধ। এই দলতন্ত্র হইতে মুক্তি চাহিলে আলোচনাভিত্তিক ব্যবস্থার দিকে আগাইতেই হইবে, কেননা তাহা দলের মধ্যে, কিংবা দলের উপরে, এক জন ব্যক্তি হিসাবে প্রার্থীর অবস্থান স্পষ্ট করে। এইখানেই আলোচনাভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণের চেষ্টার গুরুত্ব সর্বাধিক, কেননা দলতন্ত্র ভাঙিবার জন্যও ইহা একটি জরুরি অস্ত্র হইয়া উঠিতে পারে। |