টেলিফোনে আড়ি পাতা ও ইন্টারনেটে নজরদারির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে পুলিশের জন্য ১৫ কোটি টাকা খরচ করে আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রের মেগাসিটি প্রকল্পের টাকায় এই কাজ হবে বলে নবান্ন-সূত্রে খবর।
স্বরাষ্ট্র দফতরের ব্যাখ্যা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর নজরদারি বাড়াতে এই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। দফতরের এক কর্তা জানান, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে মাওবাদী তৎপরতা কমলেও একেবারে নির্মূল হয়নি। এখন আবার কেএলও জঙ্গিরা নতুন করে উত্তরবঙ্গে সক্রিয় হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে বিভিন্ন মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর সক্রিয়তা ও বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। তা ছাড়া, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও চলছে। ফলে নজরদারি ব্যবস্থা আরও বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
কিন্তু রাজ্যের বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, এই নজরদারি ব্যবস্থা আসলে তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হবে। ঘটনাচক্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন তিনিও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ তুলতেন। তা নিয়ে তখন জলঘোলাও কম হয়নি। তৃণমূলের তরফে অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের সরকার বিরোধীদের উপরে নজরদারিতে বিশ্বাস করে না। কোন পরিস্থিতিতে, কী ভাবে কারও ফোনে বা ইন্টারনেট সংযোগে আড়ি পাতা যেতে পারে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। ‘ভারতীয় টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫’-এর ৫(২) ধারা এবং ‘ভারতীয় টেলিগ্রাফ (সংশোধনী) আইন ২০০৭’-এর ৪১৯(এ) ধারায় বলা হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা, একতা, সার্বভৌমত্ব, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা এবং সেই সঙ্গে অপরাধমূলক কাজকর্ম প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এই কাজ করা যেতে পারে। |
তবে আড়ি পাততে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অথবা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমতি নিতে হবে। বস্তুত, এই অধিকারের অর্থ যে নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে আড়ি পাতার ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়া নয়, তা-ও পরিষ্কার বলা হয়েছে ওই আইনে।
স্বরাষ্ট্র দফতরের বক্তব্য, রাজ্যের ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির কথা মাথায় রেখে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর হাতে একটি ব্যবস্থা (সিস্টেম) তুলে দেওয়া হচ্ছে, যার পোশাকি নাম ‘ল’ফুল ইন্টারসেপশন ইউনিট অ্যান্ড কম্যান্ড সেন্টার’। এটি আড়ি পাতার একটি আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। কলকাতা পুলিশের কাছে এমন একটি ইউনিট আগে ছিল। কিন্তু এখন একটি উন্নততর ইউনিট কিনতে চায় তারা। যে সংস্থাটি সেনাবাহিনী এবং রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র)-কে এমন ইউনিট সরবরাহ করে, তারাই কলকাতা পুলিশকে আড়ি পাতার এই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে। এর বাইরে এসটিএফের জন্য একটি ‘জিএসএম-মোবাইল ফোন লোকেটর’-ও কেনা হচ্ছে। এতে যে কোনও জিএসএম মোবাইলের নম্বর দিলেই সেটির অবস্থান ফুটে উঠবে। কেনা হবে সারা দিনের টেলি-কথোপকথন রেকর্ডের যন্ত্র ‘১৬-চ্যানেল ভয়েস লগার উইথ ল্যাপটপ’ ও ইন্টারনেট ব্যবহারে টানা নজরদারির জন্য ‘পোর্টেবল ইন্টারনেট মনিটরিং সিস্টেম’।
এসটিএফের পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ই-নজরদারি ব্যবস্থাও সাজা হচ্ছে। লালবাজারের তরফে একটি ‘ইন্টেলিজেন্স সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ (ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের নানা যন্ত্র সমন্বিত একটি ব্যবস্থা) কেনার প্রস্তাব আগেই এসেছিল। কিন্তু মেগাসিটি প্রকল্পের টাকায় এই ধরনের যন্ত্র কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাই রাজ্য সেই প্রস্তাব আটকে রাখে। শেষে ২০১২-র ১৯ ডিসেম্বর মুখমন্ত্রী ওই যন্ত্রপাতি কেনার ছাড়পত্র দেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী নবান্নে এসে বৈঠক করেন। কলকাতা পুলিশের ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানান তিনি। আড়ি পাততে নয়া যন্ত্র কেনার বিষয়ে আপত্তি করেননি স্বরাষ্ট্রসচিব।
বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, তাঁদের উপর নজর রাখতেই আড়িপাতার যন্ত্র আসছে। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিরোধী দল, এক সময়ের শরিক দল, এমনকী নিজের দলের নেতা-মন্ত্রী, সরকারি অফিসার, কেউই তাঁর সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। আড়ি পেতে নজরদারি করাটাই এখন পুলিশের কাজ।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, “পুলিশ আইন মেনে নজর রাখলে বলার কিছু নেই। মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী থাকার সময় জানতেন, কী ভাবে এর অপব্যবহার হতো। আশা করি এখন তা হবে না।” আড়িপাতা যন্ত্রের অপব্যবহারের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আমাদের সরকার বিরোধীদের উপরে নজরদারি করে না। সে সব সিপিএম আমলে হতো।”
বাম আমলের আড়িপাতা নিয়ে এখনও সরব তৃণমূল। তখন যে বিরোধীদের ফোনে আড়িপাতা হতো তার কিছু প্রমাণও মিলেছে বলে দাবি স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার। যেমন, সিবিআই নন্দীগ্রাম তদন্তে নামলে পশ্চিমাঞ্চলের তৎকালীন আইজি অরুণ গুপ্ত কথোপকথনের ১৯টি সিডি দেন তাদের। তাতে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করেছিল পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে বাম জমানায় পুলিশের আড়িপাতা কাণ্ডে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। এ জন্য স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। তার রিপোর্ট এখনও আসেনি। |